৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২১:১৪

‘আমার বিভাগে আমিই গড’

ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন  © সংগৃহীত

‘আমার বিভাগে আমিই গড। আমি যাকে যা বলব তাকে তা-ই করতে হবে। তা না হলে তাদের কপালে অনেক দুঃখ আছে। তোরা আমার কথা না শুনলে ১০ বছরেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হতে পারবি না। পরীক্ষা দিবি, খাতা ছিঁড়ে ফেলে দেব। তোর বাবা-মা ভাত পায় না, তোরা এখানে এসে ভাব দেখাস। লাথি মেরে চার তলা থেকে ফেলে দেব।’ শিক্ষার্থীদের প্রায়ই এমন হুমকি দিতেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের (রবি) শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন।

শিক্ষিকা ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন ‘ত্রাসের রাজত্ব’ কায়েম করেন। এমন অভিযোগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানান, শিক্ষিকা ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন শুধু তার বিভাগ নয়, পুরো রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন।

তাদের অভিযোগ, তিনি কথায় কথায় বাবার পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সংস্থার ভয় দেখিয়ে ছাত্রদের নানাভাবে নির্যাতন করতেন। তার নির্যাতনের হাত থেকে পরিচ্ছন্ন কর্মীরাও রক্ষা পায়নি। তার আক্রোশের শিকার হয়ে শতাধিক শিক্ষার্থী ও কর্মচারী মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

তারা বলেন, এর ধারাবাহিকতায় তার নির্যাতনে অপমান বোধ করে গত ২৭ সেপ্টেম্বর সোমবার রাতে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের ১ম বর্ষের ছাত্র নাজমুল হাসান তুহিন ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। সে এখন হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।

শিক্ষিকা ফারহানার বিরুদ্ধে ১৪ শিক্ষার্থীর মাথার চুল কেটে দেওয়ার ঘটনায় বিচার দাবিতে উত্তাল রয়েছে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। তাকে বহিষ্কারের দাবিতে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার অনশনের দ্বিতীয় দিনে চার শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

কেবল নিজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথেই নয়, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথেই এমন আচরণ করতেন বলেও অভিযোগ করেছেন অনেকে।

রবীন্দ্র অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান লায়লা ফেরদৌস হিমেল বলেন, ‘চুল কেটে দেওয়া ছাড়াও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও খারাপ আচরণের একাধিক অভিযোগ আমরা পেয়েছি। তার বিরুদ্ধে শুধু একটি বিভাগের অভিযোগ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগেই এমন অভিযোগ রয়েছে। জুতোর শব্দ হলেও তিনি শিক্ষার্থীদের শাসন করেন। সব অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যেই এ বিষয়গুলো জানা যাবে।’

নাজমুল হাসান পাপন নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্বৈরাচারী আচরণ করেন। তিনি শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘আমাকে কেউ কিছুই করতে পারবে না। তোরা পাশ ক্যামনে করিস দেখে নেব’। ওনার কাছে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ নয়। এ কারণেই পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ওই শিক্ষকের অপসারণ দাবি করছে। দীর্ঘদিনের নির্যাতনে ছাত্ররা ফুঁসে উঠেছে’।

আবিদ হাসান নামে এক ছাত্র বলেন, ‘তিনি যে সিদ্ধান্ত নেন, সেটা আমাদের মেনে নিতে হয়। তার সিদ্ধান্তগুলো সব সময় অমানবিক হয়। আমাদের ওপর তার কর্তৃত্ব দেখান। দীর্ঘদিন পর পরীক্ষা শুরু হলেও তিনি পরীক্ষার তিন-চার দিন আগে নিয়মবহির্ভূতভাবে রুটিন দিয়েছেন, যেখানে প্রতিদিনই পরীক্ষা রয়েছে। একটি বছরের চূড়ান্ত পরীক্ষা প্রতিদিন দিতে হবে, এমন অমানবিক সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষার্থীরা ওই রুটিন পরিবর্তনের দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়ার চেষ্টা করে। পরে ওই শিক্ষিকা স্মারকলিপি দিতে আসা শিক্ষার্থীদের নাম সংগ্রহ করেন। শনিবার পরীক্ষার হলে গিয়ে পুরো চার ঘণ্টা তিনি ওই শিক্ষার্থীদের মেন্টালি টর্চার করেন। এটা নিয়ে পরদিন আমরা কথা বলতে চাইলে শিক্ষার্থীদের চুল কেটে দেবেন বলে হুমকি দেন। পরে যারা এ স্মারকলিপি দিতে চেয়েছিল তাদেরই চুল কাটা হয়েছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষক ও কর্মচারী জানিয়েছেন, শিক্ষিকা ফারহানা অত্যন্ত বদরাগী। সামান্যতেই রেগে যান এবং অকথ্য ভাষায় সবাইকে গালিগালাজ করেন। তার অত্যাচারে পরিচ্ছন্ন কর্মী এক নারী এখন আর কাজ করে না। এ নারী আয়াও তার বিভাগ ছেড়েছেন।

আত্মহত্যার চেষ্টা করা শিক্ষার্থী নাজমুল তুহিন বলেন, ‘আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা-মা অনেক আশা নিয়ে আমাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন। এমনিতেই আমরা সব সময় শঙ্কার মধ্যে দিয়ে চলি। এর ওপর আমি এমন অত্যাচার সহ্য করতে পারিনি। তাই মানসিক চাপে আত্মাহুতির পথ বেছে নেই। এখন আমার ভয়, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে ম্যাম আমার শিক্ষা জীবনটা না শেষ করে দেয়’।

সুজন নামের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্র বলেন, ‘ক্লাসের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের আক্রমণ করেন’।

তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সোহাগ, ফারাহ নাজ নিঝুম বলেন, ‘ওই শিক্ষিকা আমাদের বাবা-মা এমনকি জন্মের পরিচয় তুলেও গালি দেন। ব্যক্তিগত আক্রমণ করে কথা বলেন। তার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলে তিনি পরীক্ষায় ফেল করানোর ভয় দেখান’।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র শামীম হোসেন ও আবু জাফর বলেন, ‘ফারহানা ইয়াসমিন বাতেনের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার যোগ্যতা নেই। মানসিক বিকারগ্রস্ত ও উগ্র মেজাজের এ শিক্ষিকার কাছে কেউ নিরাপদ নয়’।

আন্দোলনকারীরা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে তারা জানতে পারেন, শাহজাদপুর পৌর এলাকার কান্দাপাড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে গোপনে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষার্থীদের একাংশ একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে ওই প্রশাসনিক ভবনের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এ সময় কর্মচারীদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে এক ছাত্র আহত হন। এতে ছাত্ররা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে প্রশাসনিক ভবনের দুটি সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর করে।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যায় বিভাগের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর সজিব সরকার বলেন, তিনি আমাকে দিয়ে কাঁচি আনিয়ে একে একে ১৪ জন ছাত্রের চুল নিজ হাতে কেটে দেন। এ সময় সেখানে দু’জন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তারা এর কোনো প্রতিবাদ করেননি।

রবির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যায় বিভাগের অফিস সহায়ক আব্দুল মালেক ঘটনার সত্যতা শিকার করে বলেন, আমিও ঘটনার সময় কাজের সহায়তায় পরীক্ষার হলে অবস্থান করছিলাম। সেখানে আমি শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিনকে ছাত্রদের চুল টেনে ধরে কাঁচি দিয়ে কাটতে দেখেছি।

সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিওতে শিক্ষিকা ফারহানা ইয়াসমিনকে কাঁচি হাতে দেখা গেছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যায়ের পরীক্ষার হলের বারান্দার মেঝেতে কাটা চুল পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত ফারহানা ইয়াসমিন বুধবার গণমাধ্যমে চুল কাটার বিষয়টি অস্বীকার করেন।

তিনি বলেন, ‘আমার একটু রাগ রয়েছে। পরীক্ষার জন্য পড়ালেখার বিষয়ে আমি শিক্ষার্থীদের একটু বকাঝকা করি। কিছু ছাত্র আমার কাছে এসে পরীক্ষা পিছিয়ে দিতে বলেছিল। আমি এতে রাজি হইনি। হয়তো সেই রাগে এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে’।

শিক্ষিকা ফারহানা ইয়াসমিনকে স্থায়ীভাবে অপসারণের দাবিতে অনশনে অসুস্থ জাহিদুল ইসলাম, আমিরুল ইসলাম, মাজিদুল ইসলাম ও জাকারিয়াকে এনায়েতপুর খাজা ইউনুস আলি মেডিকেল ও শাহজাদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে রবির অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্য ও ট্রেজারার আব্দুল লতিফ তার বক্তব্যে বলেন, শিক্ষার্থীদের এ যৌক্তিক দাবির সঙ্গে আমিও সহমত পোষণ করছি। তবে নিয়মের মধ্য দিয়ে সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কিছু সময় লাগবে। এ সময় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরে শান্ত থাকার আহ্বান জানাই।

সার্বিক বিষয়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষিকা ইয়াসমিন বাতেন মোবাইল ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।