শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পক্ষে উপাচার্যরা
করোনা মহামারির কারণে দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর খুলেছে স্কুল-কলেজ। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। তবে শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া ছাড়া খুলতে নারাজ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা।
সম্প্রতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সঙ্গে উপাচার্যদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আগামী ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে টিকার প্রথম ডোজ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত হলেও তা ধীরগতিতেই এগোচ্ছে। মূলত হল খুলে দিতেই সব শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় আনতে চান উপাচার্যরা।
জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ দেড় বছর বন্ধ থাকার পর আগামী ৫ অক্টোবর থেকে খুলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল। অন্তত এক ডোজ টিকা নেওয়ার শর্তে শুধুমাত্র অনার্স চতুর্থ বর্ষ ও মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলে প্রবেশ করতে পারবে। গত শনিবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের এক জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের অন্তত প্রথম ডোজ টিকা নিশ্চিত করে আগামী ১৭ অক্টোবর থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) খুলে দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সিন্ডিকেটের সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) খোলার সিদ্ধান্ত নিতে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর একাডেমি কাউন্সিলের সভা আহ্বান করেছে প্রশাসন। সভায় বিশ্ববিদ্যালয় খোলার তারিখ নির্ধারণ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার জানান, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর টিকা নিশ্চিত করার ব্যাপারে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা চাই শিক্ষার্থীরা অন্তত একটি টিকা নিয়ে ক্যাম্পাসে আসুক।
আগামী ১৫ অক্টোবরের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) হলগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম। মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের অন্তত একডোজ করোনা টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে ১৫ অক্টোবরের পর যেকোনো দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খুলে দেওয়া হবে।
তবে জাবি খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পূর্ব ঘোষিত একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেট মিটিং পিছিয়ে যাওয়ায় এখনই চূড়ান্ত কোন তারিখ জানাতে পারেননি তিনি। ক্যাম্পাস ও হল খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে আজ বুধবার (২২ সেপ্টেম্বর) একাডেমিক কাউন্সিল ও ২৫ সেপ্টেম্বর সিন্ডিকেট মিটিং অনুষ্ঠানের কথা ছিল। কিন্তু সেটি পরিবর্তন করে যথাক্রমে ২৯ সেপ্টেম্বর ও ২ অক্টোবর করা হয়েছে।
গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি) ভ্যাকসিনের আওতায় আসেননি প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী। ১ম ডোজ গ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ হাজার ৪২৩ জন যা মোট শিক্ষার্থীর ৪৬.৪৮ শতাংশ। দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ১৫৫ জন যা মোট শিক্ষার্থীর ৯.৬২ শতাংশ। তবে এখন পর্যন্ত সুরক্ষা অ্যাপে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভ্যাকসিনের জন্য রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন করেছেন।
বশেমুরবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব বলেন, হল খোলাসহ স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে আমরা এখনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিনি। কারণ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিনের আওতায় আসতে হবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা ভ্যাকসিন গ্রহণের বিষয়ে যে তথ্য সংগ্রহ করছি সেখানে দেখতে পেয়েছি এখনও ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীও ভ্যাকসিন গ্রহণ করেনি।
তিনি আরও বলেন, যেসকল বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার তারিখ ঘোষণা করেছে ইতোমধ্যে তাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী টিকার আওতায় চলে এসেছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা টিকার আওতায় আসলে আমরাও এধরনের কোনো তারিখ ঘোষণা করতে পারতাম৷ কিন্তু আমরা এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের জন্য টিকা গ্রহণ প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে। জন্মনিবন্ধনের মাধ্যমেই তারা রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে পারছে। তাই শিক্ষার্থীদের জন্য আমার নির্দেশনা থাকবে তারা যাতে দ্রুত রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করে টিকা গ্রহণ করে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) খোলার বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট তারিখ জানানো হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, শতভাগ টিকা নিশ্চিত হলে আগামী ২৭ সেপ্টেম্বরের পর খুলে দেওয়া হবে বিশ্ববিদ্যালয়। ইতোমধ্যে সকল বিভাগের শিক্ষার্থীদের আগামী ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায় (শাবিপ্রবি) আগামী ১৫ অক্টোবরের পর যে কোন দিন খুলে দেওয়া হবে। কবে খুলে দেওয়া হবে সে বিষয়ে একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় আলোচনা করে নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করা হবে। শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) একথা জানান শাবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কবে নাগাদ খুলে দেওয়া হবে সে বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন জানান, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ব্যাপারে আগামী ২৬ অথবা ২৭ সেপ্টেম্বরের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসিপ্লিন প্রধান ও ডিনদের সাথে মিটিং আছে। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কবে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হবে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (মাভাবিপ্রবি) সশরীরে শিক্ষা কার্যক্রম কবে থেকে শুরু হবে তা জানা যাবে আগামী ৫ অক্টোবরের পর। সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের সভা কক্ষে ক্যাম্পাস খোলা, টিকাদান ও ক্যাম্পাসে নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠিত এক সভা শেষে এই তথ্য জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. মোহা. তৌহিদুল ইসলাম।
আগামী ১ অক্টোবর থেকে আবাসিক হল খোলার ঘোষণা দিয়েছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি)। একইসাথে চলমান অনলাইন পরীক্ষাগুলো হল খোলার পরে সশরীরে অনুষ্ঠিত হবে।
মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া।
উপাচার্য বলেন, আমরা সকল ডীন, হল প্রভোস্ট, ডিরেক্টরদের সাথে মিটিং করে কিছু সুপারিশমালা তৈরি করেছি। সিন্ডিকেটে অনুমোদন সাপেক্ষে ১ অক্টোবর থেকে হল খোলার পরিকল্পনা করেছি। টিকা সনদ কার্ড (কমপক্ষে ১ ডোজ) ও আইডি কার্ড দেখিয়ে ছাত্রদের হলে প্রবেশ করতে হবে।
আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) আবাসিক হল খুলে দেওয়া হবে। এ দিন শুধু স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা হলে উঠেব। তবে অন্য সব বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য হল খুলে দেওয়া হবে ৩ অক্টোবর। মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) ডিন কাউন্সিলের আহ্বায়ক ড. এ. কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) ডিন কাউন্সিলের মিটিংয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চতুর্থ বর্ষের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে হচ্ছে ২৭ সেপ্টেম্বর। শিক্ষার্থীদের হলে থেকেই পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে।
রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রাবিপ্রবি) খুলছে আগামী ৩ অক্টোবর। সশরীরে ক্লাস শুরু হলেও আপাতত প্রত্যেক ব্যাচ এক সাথে ক্লাস করার সুযোগ পাচ্ছে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধাপে ধাপে বিভিন্ন ব্যাচকে সশরীরে ক্লাসে নেয়ার পরিকল্পনা করেছে প্রতিটি বিভাগ। ক্লাসের ক্ষেত্রে গত বছরে নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
ইউজিসি সূত্র জানায়, দেশের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪১ লাখ। এর মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী প্রায় চার লাখ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত দুই হাজার ২৫৮টি কলেজে শিক্ষার্থী প্রায় ২৮ লাখ। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পাঁচ লাখ। আর আরবি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন আরো প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী।
ইউজিসি সূত্র জানায়, গত সপ্তাহ পর্যন্ত উচ্চশিক্ষার ৪১ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ১৮ লাখ শিক্ষার্থী করোনা টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন প্রায় পাঁচ লাখ। আর দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন এক লাখের মতো শিক্ষার্থী, যাঁদের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে বলে শঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় যত দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা যায় ততই শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। অন্য দেশেও সেভাবেই শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। কিন্তু আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র তিন লাখ শিক্ষার্থীর জন্য পিছিয়ে পড়ছেন উচ্চশিক্ষার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ৩৮ লাখ শিক্ষার্থী।
ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, একেক ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা করার সুযোগ নেই। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করে টিকার প্রথম ডোজ নিতে বলা হয়েছে। এরপর নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিল ঠিক করবে কবে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে। শিক্ষার্থীরা রেজিস্ট্রেশন করলে টিকা নিতে খুব বেশি সময় লাগবে না। তবে যাদের এনআইডি নেই তাদের জন্য বিকল্প পদ্ধতিতে রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ আমরা করেছি।