০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:৩০

উচ্চশিক্ষায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নাকি সাত কলেজ?

প্রতীকী  © সংগৃহীত

প্রচলিত শিক্ষার মানোন্নয়নে ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ও পুরোনো সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অভিযোগ শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে ঢাবির অধিভুক্ত করা হলেও এখন পর্যন্ত নানান জটিলতায় সাত কলেজ অধিভুক্তির মূল উদ্দেশ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। আর এই গেড়াকলে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী সাত কলেজ ছেড়ে দারস্থ হচ্ছেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায়।

কলেজ সাতটি হলো, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, সরকারি কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। অধিভুক্তির পর থেকে এসব কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তি, প্রশ্ন প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ, ফলাফল প্রকাশ, চূড়ান্ত সার্টিফিকেট প্রদানসহ শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়গুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই দেখভাল করছে। বর্তমানে এই সাতটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত রয়েছে প্রায় আড়াই লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। অধিভুক্তির পর থেকে সাত কলেজে ডিগ্রী কোর্স বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, এখন পর্যন্ত দীর্ঘ সময় পেরুলেও নানান জটিলতায় অধিভুক্তির মূল উদ্দেশ্য ‘শিক্ষার মানোন্নয়ন’ অর্জন করতে পারেনি সাত কলেজ। যথাসময়ে পরীক্ষা গ্রহণ করতে না পারা, পরীক্ষা পদ্ধতি ও প্রশ্নপত্র প্রণয়নে জটিলতা, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রিতা, বিভিন্ন বিভাগে গণহারে ফেইলসহ নানাবিধ সমস্যার সুরাহা অধিভুক্তির ৫ বছরেও হয়নি।

তবে শিক্ষার মানোন্নয়ন হয়নি একথা মানতে নারাজ সাত কলেজের সাবেক সমন্বয়ক ও ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আইকে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার। তিনি বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার পর থেকে কিছুটা জটিলতার ছিল। তবে এখন এটি আর নেই। করোনা পরিস্থিতির আগেই সকল শিক্ষাবর্ষের সার্বিক কার্যক্রম আমরা স্বাভাবিক নিয়মতান্ত্রিকতার মাঝে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু করেনা পরিস্থিতিতে আবারও হোঁচট খেতে হল। এর মাঝেও চূড়ান্ত পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করছি ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার। এছাড়াও সেশনজট নিরসনে ৮ মাসে শিক্ষাবর্ষ শেষ করার পরিকল্পনাও আমাদের রয়েছে।

আরও পড়ুন: ফুল-ফ্রি স্কলারশিপে ফ্রান্সে উচ্চশিক্ষা, আবেদন শেষ ১০ জানুয়ারি

অধ্যাপক সেলিম আরও বলেন, ঢাবির সরাসরি তত্ত্বাবধানে স্নাতকে ভর্তিকৃত তিনটি শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে। তবে পিছিয়ে পড়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ভর্তি হওয়া স্নাতক ২০১৪-১৫, ২০১৬-১৭ সেশন ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির কয়েকটি ব্যাচ। এসব শিক্ষাবর্ষের কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে সাত কলেজের নানা জটিলতার সঙ্গে পথ পাড়ি দিতে না পেরে কলেজ ছেড়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন—এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। এমনই একজন শিক্ষার্থী রিফাত আহমেদ (ছদ্মনাম)। স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি যুদ্ধে টিকে ঢাকা কলেজের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলেও বছর না ঘুরতেই চূড়ান্ত পরীক্ষায় ফলাফলের চরম বিপর্যয় মাথায় নিয়ে ভর্তি হন রাজধানীর একটি প্রথম সারির প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে।

রিফাত দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার এই দীর্ঘ সময়ের শিক্ষাজীবনে এত খারাপ পরীক্ষার রেজাল্ট কখনো হয়নি। আমি চূড়ান্ত পরীক্ষায় যেমনটি লিখেছি নাম্বার কম পেলেও একেবারে তিন বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ার মতো নয়। কেন এমন ফলাফল বিপর্যয় হলো সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা আমার সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকেও পাইনি।

তিনি আরো বলেন, নির্দিষ্ট সিলেবাস, একাডেমিক ক্যালেন্ডার না থাকায় এবং প্রশ্নপত্র, মানবন্টন ও পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা না থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ ফলাফল বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। আবার ফলাফল বিপর্যয়ের পর কোন ধরনের ঘাটতি অথবা কারণগুলো শিক্ষার্থীদের সম্মুখে উন্মোচিত করা হচ্ছে না। যার ফলে প্রতিটি শিক্ষাবর্ষেই কিছু কিছু শিক্ষার্থী অকালেই ঝরে পড়ছে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার স্বপ্ন ধরা দিচ্ছে না বাস্তবে।

সাত কলেজ ছেড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন এমন আরেকজন শিক্ষার্থীর সাথে কথা হয় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের। তিনি জানান, ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পছন্দের বিভাগে ভর্তি হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী ক্লাস এবং পড়াশোনার স্পষ্ট নির্দেশনা না পাওয়ায় মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এরপর বাধ্যহয়েই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষা কার্যক্রম।

তবে শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করতে নিয়মিত ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিতি না থাকলে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না দেয়ার মতো কঠোর সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়েছে ইতোমধ্যেই। নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা গ্রহণে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, বাংলা কলেজ ও বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ কিছুটা এগিয়ে থাকলেও পর্যাপ্ত শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষ ও অবকাঠামোর অভাবে কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ অনেকটাই পিছিয়ে।

তবে সামগ্রিকভাবেই সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ধারণ ক্ষমতার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি নেয়া হয় প্রতিটি শিক্ষাবর্ষে। যার ফলে কিছু বিভাগে শ্রেণিকক্ষে ঠিকমতো বসার জায়গাও পাননা শিক্ষার্থীরা।

এছাড়াও নানা বিষয়ে সাতটি কলেজের প্রশাসনের মধ্যকার সমন্বয়হীনতার অভিযোগও রয়েছে শিক্ষার্থীদের। তারা বলছেন, অনেক বিষয়েই কলেজ থেকে সমাধান না করে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো হয় কলেজে। এমন অবস্থায় সমস্যার সমাধানে গিয়ে নতুন সমস্যায় হয়রানির শিকার হতে হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের।

এমন পরিস্থিতিতে সাত কলেজে কোন বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে নতুন শিক্ষার্থীদের ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ - এমন প্রশ্ন ছিল সাত কলেজের বেশকিছু শিক্ষার্থীদের কাছে।

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান বলেন, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে মানসম্মত ও টেকসই শিক্ষা অত্যাবশ্যকীয়। সাত কলেজে ভর্তি হওয়া মানেই জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়া বিষয়টি মোটেও তেমন নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি তত্ত্বাবধানে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের সেশনজট একেবারে নেই বললেই চলে। তাই যারা নতুন করে সাত কলেজে ভর্তি হতে চাচ্ছে তাদের অবশ্যই নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, নিজউদ্যোগে অধ্যবসায় ও পরিকল্পিত পাঠের বিষয়ে সমন্বয় করতে হবে। এছাড়াও সাত কলেজ প্রশাসনকেও শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতেও আরো বেশি তৎপর হওয়া উচিত বলে মনে করছেন তিনি।

পরীক্ষার ফলাফল বিপর্যয় রোধে ও ভালো ফলাফল করার জন্য শিক্ষার্থীদের নিয়মিত স্ব-স্ব কলেজের বিভাগীয় শিক্ষকদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার মাধ্যমে ক্লাস ও ইনকোর্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলে সাত কলেজে পড়েও ভালো ফলাফল নিয়ে বের হওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী হাবিবা ইয়াসমিন। তবে একই সাথে সাত কলেজের শিক্ষকদের আরও বেশি শিক্ষার্থী বান্ধব হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন তিনি।

এছাড়াও এক বছর পরপর চূড়ান্ত পরীক্ষা গ্রহণ না করে সাত কলেজে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করলেও শিক্ষার মানোন্নয়ন এর পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও বেশ উপকৃত হবে বলেও মনে করছেন অনেকে।

তবে বেশকিছু ভালো সুবিধাও রয়েছে সাত কলেজে। সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় তুলনামূলক অল্প খরচে ২৫টি বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা যায় সাত কলেজ থেকে। প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে অধিকাংশ কলেজেই রয়েছে আবাসন সুবিধা। তথ্যমতে সাতটি সরকারি কলেজের মধ্যে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সরকারি বাঙলা কলেজে আবাসিক হল রয়েছে৷ সব মিলিয়ে এই কলেজগুলোর প্রায় ত্রিশ হাজার আবাসিক শিক্ষার্থী রয়েছে৷ প্রায় ছয়টি প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা। শ্রেণিকক্ষ স্বল্পতা কাটাতে ইতোমধ্যেই অবকাঠামোগত উন্নয়নেও নজর দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সব মিলিয়ে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সাত কলেজের চলমান সংকট ধীরে ধীরে কমে যাবে বলেও প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের।