বেরোবির অধ্যাপক সেলিমের সম্পদের তদন্তে দুদক
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয় অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. আর এম হাফিজুর রহমান সেলিমের সম্পদের হিসাব নিতে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রংপুর নগরীর অভিজাত এলাকায় ছয় তলা বিশিষ্ট আলিশান বাড়িসহ বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়া নিয়ে এই তদন্ত করছে দুদক।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুল আলোচিত উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহর দুর্নীতি ক্ষমতার অপব্যাবহার নিয়োগ বাণিজ্যসহ কোটি কোটি টাকা লুটপাটের প্রধান সহযোগী ছিলেন অধ্যাপক আরএম হাফিজুর রহমান। ওই উপাচার্যের আমলে প্রকাশ্য দিবালোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক দুর্নীতির দালিলিক প্রমাণাদি ২২ বস্তা কাগজ নিজেই দাঁড়িয়ে থেকে পুড়িয়েছেন তিনি। এ ঘটনায় পুরো বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়।
সেসময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছবিসহ পোড়ানোর খবর প্রকাশিত হওয়ার পরও সাবেক উপাচার্য তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি। এছাড়া নিয়োগ বাণিজ্য, ভাউচার বাণিজ্য, স্বনামে বেনামে বিভিন্ন প্রকল্পের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ করেছে বঙ্গবন্ধু পরিষদ, অধিকার সুরক্ষা পরিষদসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
জানা যায়, রংপুর নগরীর অভিজাত এলাকা সার্কিট হাউজ রোডে পুলিশ সুপারের বাসভবনের পেছনেই ছয় তলা বিলাসবহুল বাসভবন গড়ে তুলেছেন অধ্যাপক হাফিজুর রহমান সেলিম। সর্বাধুনিক বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে বাড়িটি সাজানো হয়েছে। গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীদের হিসাব অনুযায়ী বাড়িটি তৈরি করতে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। তবে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে আলিশান বাড়ি নির্মাণের অর্থ আসল কোত্থেকে এ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে। বিশাল এলাকাজুড়ে বাড়িটির সামনে খোলা-মেলা জায়গা অনেক গাড়ি রাখার স্থানসহ ব্যাপকভাবে সজ্জিত করা হয়েছে। এই বাড়িতেই পরিবার নিয়ে বাস করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিনিধিকে বলেন, একবার কয়েকজন শিক্ষক মিলে বাড়িটি দেখার সৌভাগ্য তাদের হয়েছে। বাড়িতে সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধার এমন কিছু নেই যা সেখানে নেই। বাসাটির নিচ তলাসহ একটি অংশ বিদেশি সাহায্য সংস্থা কেয়ারকে ভাড়া দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ৬ তলা বাড়ির প্রতিটি তলায় রয়েছে ২/৩টি করে ফ্ল্যাট।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক গণিত বিভাগের শিক্ষক মশিউর রহমান বলেন, শিক্ষা জীবনে একটি মাত্র বিভাগে প্রথম শ্রেণী পাওয়া হাফিজুর রহমান সেলিম কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক ছিলেন। রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলে প্রথমে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় নগরীর ধাপ এলাকার পিটিআই সংলগ্ন ক্যাম্পাসের বেশ কয়েকটি ভবনে। সেই সময় তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল জলিলের মাধ্যমে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। কিছুদিন না যেতেই তিনি ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের পদ বাগিয়ে নেন।
এ সময় শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারী পদে ব্যাপক নিয়োগ বাণিজ্য হয়। এ ঘটনায় তৎকালীন উপাচার্য আবদুল জলিল মিয়ার বিরুদ্ধে দুদক আইনে মামলা হয়েছে। সেই মামলায় বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেন উপাচার্য।
তবে কৌশলে দুদকের মামলা থেকে রেহাই পেয়ে যান তিনি। তৎকালীন উপাচার্য আবদুল জলিল হাফিজুর রহমান সেলিমের বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ পেলে তাকে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের পদ থেকে সরিয়ে দেন। এরপর উপাচার্য ড. নুর- উন নবীর আমলে কোন সুবিধা না পেলেও সদ্য বিদায়ী উপাচার্য কলিম উল্লাহর দক্ষিণ হস্ত হয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। কলিম উল্লাহ তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম ভঙ্গ করে অর্থ পরিচালক পদে নিয়োগ দেন। এরপর তাকে সিন্ডিকেট সদস্য করেন। এছাড়া বিজ্ঞান বিভাগের ডিন হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। এক সঙ্গে তিনটি পদ বাগিয়ে নেয়ার পর ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেন তিনি।
এছাড়া বিজ্ঞান বিভাগের ডিন হিসেবে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি কমলেশ চন্দ্র রায় হওয়ার কথা থাকলেও তিনি যাতে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি না পান সেজন্য কৌশলে তার পদোন্নতির বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখে নিজেই বিজ্ঞান বিভাগের ডিন হয়ে যান। এদিকে অর্থ পরিচালক পদে দুই বছর পূর্ণ হওয়ার পর আবারও হাফিজার রহমান সেলিম পুনরায় দু’বছরের জন্য একই পদে নিয়োগ হাতিয়ে নেন। তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে আলিশান বাড়ি নির্মাণসহ তার বিপুল সম্পদ অর্জনের বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানান।
এদিকে অধিকার সুরক্ষা পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক মতিউর রহমান বলেন, আমরা ইউজিসির কাছে সাবেক উপাচার্য কলিম উল্লাহসহ তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি নিয়োগ বাণিজ্য, ক্ষমতার অব্যাবহারসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সম্বলিত ১শ’ ১১টি অভিযোগ প্রদান করা হয়েছে। সেখানে হাফিজার রহমান সেলিমের নিয়োগবিধি সম্মত হয়নি বলে আমরা বলেছি। তার বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে তা তদন্ত করা প্রয়োজন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে অর্থ পরিচালক অধ্যাপক হাফিজার রহমানের সেলিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বাসাটি তার নয় তার স্ত্রীর। তার স্ত্রীরা তিন বোন মিলেই বাড়িটি নির্মাণ করেছে। তিনি বলেন, আমি গ্র্যাচুয়িটির টাকা ও নগরীর লালবাগে একটি জায়গা বিক্রি করেছি, এছাড়া বিভিন্নভাবে টাকা সংগ্রহ করে বাসাটি নির্মাণ করা হয়েছে। আমার বাড়ি নির্মাণে কোন অবৈধ অর্থ নেই, আমি নিজেই অবৈধ উপায়ে এক টাকাও অর্জন করিনি। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে আমাকে হেয় করার জন্য।
অন্যদিকে সদ্য নিয়োগ পাওয়া উপাচার্য অধ্যাপক হাসিবুর রশীদ বলেছেন, বিগত দিনে যারা দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যাবহার করেছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।