২৫ এপ্রিল ২০২১, ২২:৪৩

জবিতে পরিপত্র না মেনে লাখ লাখ টাকা লোপাটের অভিযোগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ফটো

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) প্রশাসনের শীর্ষকর্তা ও অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সরকারের পরিপত্র না মেনে বছরের পর বছর লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযাগ উঠেছে। কোন কর্মচারীকে ১০ হাজার টাকার অধিক বা একই অর্থবছরে একবারের অধিক (যে কোন অঙ্ক) সম্মানী প্রদানের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের সম্মতি বা অনুমোদন গ্রহন করার নিয়ম রয়েছে। এছাড়া রুটিন কাজের জন্য কোন সম্মানী প্রদান করা যাবে না বলে পরিপত্রে বলা হয়েছে। কিন্তু এ পরিপাত্র না মেনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের শীর্ষকর্তা ও অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাগণ বছরের পর বছর হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৮ মার্চ অর্থ মন্ত্রনালয়ের সর্বশেষ পরিপত্র অনুযায়ী অর্থ বিভাগের ব্যয় নিয়ন্ত্রন অনুবিভাগ কর্তৃক জারিকৃত আর্থিক ক্ষমতা অর্পন সংক্রান্ত নির্দেশনা মোতাবেক বাজেটে অর্থ সংকুলান সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রনালয়/বিভাগ/দপ্তরের একজন কর্মচারীকে বছরে একবার সর্ব্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত সম্মানী প্রদান করতে পারবে।

আর বিশ্ববিদ্যালয় সান্ধ্যকালীন কোর্সের নীতিমালা অনুযায়ী, প্রত্যেকটি বিভাগ কোর্সের ৩৩ শতাংশ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জমা হয়। কিন্তু এই ৩৩ শতাংশ অর্থের ব্যয়ের কোন স্পষ্ট নীতিমালা নেই। এই অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যে যার মত করে ব্যয় দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে শিক্ষকদের আয়কর প্রদানের বেতন বিবরণীর কাজ দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালিন ট্রেজারার অধ্যাপক সেলিম ভূঁইয়া ৭৬ হাজার টাকা, অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক কাজী নাসির উদ্দিন এক বেসিকের সমপরিমান অর্থ ৫৪ হাজার টাকা, অতিরিক্ত পরিচালক সৈয়দ আহমেদ ৬৮ হাজার টাকা, উপ-পরিচালক হাবিবুর রহমান ৬১ হাজার টাকা, ইব্রাহিম মিয়া ৫১ হাজার টাকা, সহকারী পরিচালক সঞ্জয় কুমার ৩৪ হাজার টাকা, সহকারী পরিচালক তরিকুল ইসলাম ৩৪ হাজার টাকা, সহকারী পরিচালক এছান আহমেদ ৩৪ হাজার টাকা, সহকারী পরিচালক আব্দুল কাদের খান ৩৪ হাজার টাকা, সহকারী পরিচালক (অডিট) আমিনুল ইসলাম ৩৪ হাজার টাকা, একাউন্ট অফিসার ইসরাফিল মিয়া ২৫ হাজার টাকা গ্রহণ করেন।

এছাড়া ২০১৯-২০ প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণীতে ভর্তির কাজ, পরীক্ষার পারিতোষক, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ইউজিসিতে বাজেটের প্রস্তাব পাঠানোর কাজ দেখিয়ে আলাদা আলাদা বেসিক সমপরিমাণ অর্থ গ্রহন করেন।

অর্থ ও হিসাব দপ্তরের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, প্রত্যেক বছরই নানা অযুহাতে ওই কর্মকর্তারা অবৈধ সম্মানী গ্রহণ করে আসছেন। ২০১৯-২০ অর্থ বছরের জুনে বাজেট করার কাজ দেখিয়ে এ কর্মকর্তারা বেসিক পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করেন।

জানা গেছে, কাজী নাসির উদ্দিন ২০১৯ সালের ২৪ জুন অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক হিসাবে যোগদান করেন। জুনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ অর্থ বছরের বাজেটের কাজ দেখিয়ে এ পরিচালক ছয় দিনের বিপরীতে এক মাসের সমপরিমাণ ৫২ হাজার টাকা নিয়েছেন।

২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইভিনিং প্রোগ্রামের কাজ দেখিয়ে অর্থ ও হিসাবে দপ্তরের পরিচালক কাজী নাসির উদ্দিন এক লাখ ২০ হাজার টাকা, অতিরিক্ত পরিচালক সৈয়দ আহমেদ এক লাখ ৩৬ হাজার টাকা, উপ-পরিচালক হাবিবুর রহমান এক লাখ ২২ হাজার টাকা, ইব্রাহিম মিয়া এক লাখ দুই হাজার টাকা, সহকারী পরিচালক সঞ্জয় কুমার ৬৮ হাজার টাকা, সহকারী পরিচালক তরিকুল ইসলাম ৬৮ হাজার টাকা, সহকারী পরিচালক এছান আহমেদ ৬৮ হাজার টাকা, সহকারী পরিচালক আব্দুল কাদের খান ৬৮ হাজার টাকা, সহকারী পরিচালক (অডিট) আমিনুল ইসলাম ৬৮ হাজার টাকা, একাউন্ট অফিসার ইসরাফিল মিয়া ৫০ হাজার টাকা গ্রহণ করেন।

এছাড়াও ২০১৯ সালের ৩ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার অধ্যাপক সেলিম ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত উপদেশ পত্র ৫৭-এর থেকে ইভনিং এমবিএ প্রোগ্রাম-জবি স য়ী নং ০২০০০০২০৩২৫৫২ হতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের ব্যাংক হিসাব নং ০২০০০০১৯৪৩৮৫৯ এ ৭৮ হাজার টাকা, অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক কাজী নাসির উদ্দিনের ব্যাংক হিসাব নং ৩৪০২৪৮৬৬ এ ৫৪ হাজার ৮০ টাকা, উপ-পরিচালক খন্দকার হাবিবুর রহমানের ব্যাংক হিসাব নং ৩৪০২৩৩৬৩ এ ৬০ হাজার ৮৪০ টাকা, উপ-পরিচালক ইব্রাহিম মিয়ার ব্যাংক হিসাব নং ২০০০০১৫৫৪০১৬ এ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা, সহকারী পরিচালক সঞ্জয় কুমার পালের ব্যাংক হিসাব নং ০২০০০০১১৯১০৬০ এ ৩৩ হাজার ৫৮০ টাকা, সহকারী তরিকুল ইসলামের ব্যাংক হিসাব নং ২০০০০১৪০২২৭৩ এ ৩৩ হাজার ৫৮০ টাকা, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. ইসরাফিলের ব্যাংক হিসাব নং ২০০০০১৬৩২৩৪৩ এ ২৫ হাজার ৪৮০ টাকা গ্রহণ করেন।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা ইভনিং এমবিএ-এর নীতিমালা অনুযায়ী প্রত্যেক মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার ১০ হাজার, প্রধান প্রকৌশলী ১০ হাজার টাকা, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ১০ হাজার টাকা, অতিরিক্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ৯ হাজার টাকা, অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক ১০ হাজার টাকা, অতিরিক্ত পরিচালক ৯ হাজার টাকা, উপ-পরিচালক আট হাজার টাকা, সহকারী পরিচালক ছয় হাজার টাকা, হিসাবরক্ষন কর্মকর্তা পাঁচ হাজার টাকা গ্রহণ করেন।

এ বিষয়ে অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক কাজী নাসির উদ্দিন ও উপ-পরিচালক হাবিবুর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।

উপ পরিচালক ইব্রাহিম মিয়া অতিরিক্ত কাজ দেখিয়ে অর্থ গ্রহনের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ট্রেজারার দুইজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা। তাই তারাও একই আইনে এ অর্থ গ্রহণ করেন।’ তবে অতিরিক্ত সম্মানী গ্রহণে অর্থ মন্ত্রনালয়ের পরিপত্র ভঙ্গ করা হচ্ছে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি আপনারা কাগজে দেখেন।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. শওকত জাহাঙ্গীর বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত কাজ দেখিয়ে শুধু বাজেট প্রণয়নের সময় একটি বেসিক গ্রহণের সুযোগ আছে। বিভিন্ন খাতের কাজ উল্লেখ করে একাধিকবার বেসিক সমপরিমাণ সম্মানী গ্রহণ করা অনুচিত। আমাদের ইভিনিং এমবিএ সম্মানী গ্রহণের যে নীতিমালা প্রণীত হয়েছিল তাতে অনেক অস্পষ্টতা আছে।’

তিনি বলেন, ‘এ নীতিমালা প্রণয়ণের সময় ডিনদের রাখা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন। এ নীতিমালায় কতজন কর্মকর্তা, কর্মচারী কারা করা কত সম্মানী পাবেন তা স্পষ্ট নয়। এই অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে অনেকে বেশি অর্থ গ্রহণ করেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক অটোনেমি থাকলেও ফাইন্যান্সিয়াল অটোনমি নেই। এ বিষয়টিতে আমরা সবসময় ভুল করি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা হওয়ায় আমরা অনেক সময় নিজেদের মত করে ব্যখ্যা দেই।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি নূরে আলম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব দপ্তরের ভাষ্য অনুযায়ী বছরে একটির বেশি বেসিক পরিমাণ সম্মানী গ্রহণের সুযোগ নেই।’

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বে থাকা ট্রেজারার অধ্যাপক ড. কামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সরকার ও ইউজিসির দুইটি অডিট টিমের মাধ্যমে অর্থ হিসাব দপ্তরের সম্মানীর হিসাবগুলো নিষ্পত্তি করা হয়। এরপরও যদি সেখানে কোন ধরনের অসঙ্গতি থাকে তাহলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় অর্থ ও হিসাব দপ্তরের লাখ লাখ টাকার অডিট আপত্তি রয়েছে।