আবেগঘন বিদায় খুবি উপাচার্যের, বিতর্কও পিছু ছাড়েনি দশকজুড়ে
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ করে কর্মস্থল ত্যাগ করেছেন। শেষ দিনে উপাচার্য আবেগে আপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বিদায়বেলায় চার শতাধিক শিক্ষক-কর্মকর্তার ভালবাসায় সিক্ত হয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) দুপুর ৩টার দিকে উপাচার্য বাসভবন থেকে বের হয়ে মেইন গেট পর্যন্ত হেটে যান। এসময় রাস্তার দুপাশে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিদায় জানান তাকে।
জানা গেছে, উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আজ শুক্রবার (৩০ জানুয়ারী)। তবে ছুটির দিন হওয়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) কর্মস্থল ত্যাগ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ফিরে গেছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, ট্রেজারার, বিভিন্ন স্কুলের ডিন, ডিসিপ্লিন প্রধান, বিভাগীয় প্রধান উপাচার্যের গাড়ির সাথে বিশাল গাড়ীবহরের যাত্রায় অংশ নেন।
গণমাধ্যমকে উপাচার্য বলেন, এ দিনটি আমার জীবনের স্মরণীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত শিক্ষার্থী আমাকে বিদায় জানাতে এসেছেন এটা অভূতপূর্ব। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেনো এ ধারা অব্যাহত থাকে এবং দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে চলতে পারলে এ বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভাবনার পথে, সাফল্যের পথে বহুদূর এগিয়ে যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
কেমন ছিল উপাচার্যের এক দশক
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষক-কর্মকর্তা কর্মচারীরাদের অভিযোগ রয়েছে, উপাচার্য শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট নিয়োগে প্রাধান্য দিতে গিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবি ও যোগ্য অনেক গ্রাজুয়েট বঞ্চিত হয়েছেন। কর্মচারীর ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আত্মীয়-স্বজন এবং পরিবারের সদস্য নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে। এমনকি বিদায়ের শেষ সপ্তাহেও অস্থায়ী ভিত্তিতে বেশ কয়েকজন কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন বলে জানা যায়।
এছাড়া তাঁর কার্যকালে প্রশাসনের সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের অন্যত্র সরিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ফলে দলীয় বিবেচনায় অদক্ষ কর্মকর্তাদের দিয়ে প্রশাসন চালাতে তাঁকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে, যা তিনি অনেক সময় নিজেও প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। উপাচার্য নিজেকে সৎ দাবি করলেও তাঁর প্রশাসনে তোষামোদকারী অসৎ কর্মকর্তাদের প্রশ্রয় ও পুরষ্কৃত করার অভিযোগও ছিল। একইভাবে বিভিন্ন স্কুলের ডিন নিয়োগ নিয়েও নিজেকে বিতর্কমুক্ত রাখতে পারেননি তিনি।
এ নিয়ে সমমনা শিক্ষকদের সাথেও তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়। কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিনের বিরাজমান সমস্যা সমাধানে বার বার অশ্বাস দিলেও উপাচার্য হিসেবে দুই মেয়াদে তিনি সমাধান করেননি। ফলে যে কর্মকর্তারা উপাচার্যের দ্বিতীয় র্টামের দায়িত্ব গ্রহণকালে ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত করেছিলেন, তারাই হতাশা ও ক্ষোভ থেকে বিদায় বেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠান বর্জন করেন। যেখানে বিভাগীয় প্রধানদের অনেকেই ছিলেন অনুপস্থিত। দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রকাশ্যে আসার ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সভা আহবান না করা এবং সিন্ডিকেট পুনর্গঠনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ভঙ্গের অভিযোগ ওঠে বিদায়ী এই উপাচার্যের কার্যকালের শেষের দিকে।
প্রশাসনের বিভাগীয় প্রধানদের পদে শিক্ষকদের দায়িত্ব প্রদানের রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান, এমন অভিযোগ করেছেন কর্মকর্তা পরিষদের বর্তমান সভাপতি মুজিবুর রহমান। এছাড়া তাঁর কার্যকালে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ তৈরী হয় বলে জানা যায়।
বিভিন্ন অভিযোগ প্রসঙ্গে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান বলেন, ‘কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে আমার জেলা বা তার আশেপাশের কেউ নিয়োগ পেলে সবাই মনে করে আমার আত্মীয়। কিন্তু কয়েকটা জেলার সব লোক আমার আত্মীয় হওয়া কি সম্ভব! যারা নিয়োগ পেয়েছেন তারা তাদের যোগ্যতা দিয়েই এখানে এসেছেন। আর সর্বশেষ এই নিয়োগের সুপারিশ এসেছে ছাত্রবিষয়ক পরিচালক এর দপ্তর থেকে।’
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান উপাচার্যের দায়িত্ব নেয়ার পর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চা বাধাগ্রস্থ হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি সময়ে দুই ছাত্রের বহিষ্কারাদেশ ও তিন শিক্ষকের বরখাস্তাদেশ দেশব্যপী আলোচিত ও সমালোচিত হয়। এর মধ্যে ছাত্রদের ইস্যুটি আপাতত সুরাহা হলেও শিক্ষকদের বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারে বলে তাদের ঘনিষ্ট সূত্রে জানা যায়।
এর আগে কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ায় তারাও উচ্চ আদালতের আশ্রয় নেন। তবে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সেশনজট কমাতে একাডেমিক ক্যালেন্ডার গঠন করে এক সাথে সকল ব্যাচের ক্লাস শুরু হওয়া এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্লাস, পরীক্ষা সম্পন্ন করে ফলাফল দেওয়ার উদ্যোগ বেশ প্রশংসিত হয়েছে। এছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যার মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় মসজিদ, মন্দির নির্মাণ, শিক্ষার্থীদের দুটি হল সম্প্রসারণ, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী, গবেষণাগার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়াসহ বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করেন।
দেশের প্রথম সয়েল আর্কাইভ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয় তার কার্যকালে। তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্ত বুদ্ধি চর্চার জায়গা। আমি কখনো এখানে মত প্রকাশে বাধা প্রদান করেনি। আমি যখন এসেছিলাম তখন শিক্ষার্থীদের মাত্র ১৪/১৫টি সংগঠন ছিলো, আর এখন প্রায় ৩০টি সংগঠন। ভিন্ন ভিন্ন মত থাকবে, তবে আমি চেষ্টা করেছি সবার মতকে সম্মিলিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজে লাগাতে।’
উন্নয়ন কাজে ধীর গতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ১৩৫ কোটি টাকার বাজেটকে আমরা ৩৫৫ কোটি টাকা করেছি। পাশাপাশি আগামী একশ’ বছর পরের কথা চিন্তা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন যে ভবন তৈরী হবে তার সম্প্রসারণ পরিকল্পনা করেই কাজ করেছি। এজন্য সময় কিছুটা বেশি লাগছে। তাছাড়া টেন্ডার এবং ডিজাইন আহবান করে সেগুলো সঠিকভাবে যাচাই বাছাই করতেও সময় প্রয়োজন হয়।’ এছাড়া প্রশাসনের বিভাগীয় প্রধানদের ভারপ্রাপ্ত পদগুলোতে নতুন উপাচার্য এসে সিদ্ধান্ত নিয়ে দক্ষ ও যোগ্য লোক বসাবেন এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
জানা যায়, তিনি ২০১০ সালের ২৮ নভেম্বর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে যোগদান করেন । এরপর ২০১২ সালে ভারপ্রাপ্ত ভিসি হিসেবে যোগদানের পরে ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি প্রথম মেয়াদে যোগদান করেন। পরে ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে পুনরায় উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আগে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।