হলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দাবিও জোরালো হচ্ছে
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে নয় মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত নভেম্বরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স-মাস্টার্স ফাইনাল সেমিস্টারের ব্যাবহারিক ক্লাস-পরীক্ষা গ্রহণের অনুমতি দেয়ার পর চলতি মাসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পরীক্ষা নেয়ার অনুমতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তবে আবাসিক হল বন্ধ রাখার পরামর্শ দেয়া হয়। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি সীমিত পরিসরে হল খোলার দাবি তোলেন শিক্ষার্থীরা। এই দাবির সাথে নতুন করে জোরালো হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দাবিও। অবশ্য করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ আবাসিক হল খোলার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রায় ১০ মাস পর পরীক্ষা নেয়ার অনুমতি দেয়া হলেও হল খোলার অনুমতি দেয়া হয়নি। এতে করে দূর-দূরান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থী কোথায় থেকে পরীক্ষা দেবে সেটিও পরিস্কার নয়। এমন অবস্থায় হল খোলা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই। অন্যদিকে দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর জীবন থমকে গেছে। এমন অবস্থায় সীমিত পরিসরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেয়া উচিৎ। কেননা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে দীর্ঘ সেশনজটে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন করে আবারও ছুটি বাড়লে সেই জট দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। তাই আবাসিক হলগুলোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও খুলে দেয়ার দাবি তাদের।
দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সামগ্রিকভাবে শিক্ষা খাত বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে কখনোই করোনার প্রকোপ কমানো সম্ভব নয়। তবে ছাত্র-ছাত্রীরা হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। আর আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কোনোভাবেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলা উচিত হবে না। সে হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত যথার্থই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রোকনুজ্জামান বলেন, দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় দীর্ঘ সেশন জটের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন বাড়িতে থেকে একঘেয়েমি চলে এসেছে। পড়ালেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠানই চলছে স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই। পিকনিক স্পটগুলোতে পা রাখার জায়গা নেই, নেই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধিও। বড়-ছোট সব শহর-গ্রামেই গণ-জমায়েত হচ্ছে পূর্বের মতই। এতো কিছুর পরেও শুধু স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখাটা সমীচীন নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা তখনই যৌক্তিক হবে, যখন দেশের সব পাবলিক প্লেসসহ সকল ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা যাবে। সবকিছুই যখন স্বাভাবিকভাবে চলছে তখন সীমিত পরিসরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও খুলে দেয়া উচিত।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী শাহাদত বিপ্লব বলেন, আমরা যদি অন্যান্য দেশের দিকে তাকাই তাহলে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা এতো দীর্ঘসময় ধরে বন্ধ ছিলো না। তারা বিকল্প পন্থায় শিক্ষা কার্যক্রম সচল রেখেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের শিক্ষা-কার্যক্রম বলতে গেলে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে আছে। অনলাইন ক্লাস যা হচ্ছে তা নামমাত্র। প্রায় বছর ধরে কার্যক্রম বন্ধ মানে প্রতিটি শিক্ষার্থী ১ টি বছর পিছিয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট প্রকট আকার ধারণ করছে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর পরিবারই তার সন্তানের পড়ালেখা শেষ করার দিকে তাকিয়ে আছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ক্রমেই বাড়ছে। এগুলো নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। যেহেতু সব কিছুই স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনেকটা স্বাভাবিকভাবে চলছে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ রাখার কোন যৌক্তিকতা নেই। এখানে যারা পড়ালেখা করে তারা যথেষ্ট ম্যাচিউর্ড। তাই আমার মনে হয় যত দ্রুত সম্ভব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেয়া উচিত।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সৌম্য সরকার বলেন, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্নাতক শেষ করে ক্যারিয়ার গড়ার যে স্বপ্ন ছিলো তা এখন অনিশ্চিত। এদিকে চাকরির বয়স পার হতে চললেও অনার্স শেষ করতে না পারায় আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের কথা এবং তাদের পরিবারের কথা চিন্তা করে হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া উচিৎ। যেহেতু সব প্রতিষ্ঠান খোলা তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন নয়?
এদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার প্রাদুর্ভাব কিছুটা কমে আসার পর বিশ্বের অনেক দেশই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছিল। তবে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় আবার তারা তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া দেশে শীত চলে আসায় করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চায় না সরকার। শীত কমে আসলে আগামী মার্চে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করা যেতে পারে। আর হল খুলে দিলে সেখানে শিক্ষার্থীদের সমাগম সীমিত রাখা প্রায় অসম্ভব। কেননা একেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০-৩০ হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। হল খুলে দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ও খুলে দেয়ার দাবি উঠবে। তাই আবাসিক হল বন্ধ রেখেই পরীক্ষা আয়োজন করার কথা বলা হয়েছে।
তবে অনলাইন ক্লাসের মান বাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কমিয়ে আনার দিকে জোর দিতে বলেছেন অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলা সম্ভব হচ্ছে না, সেহেতু অনলাইন শিক্ষার উপর জোর দেয়া দরকার। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস-পরীক্ষা নিচ্ছে। তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আমাদের উন্নত দেশগুলোকে ফলো করা উচিত।
হল খোলার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল যদি মনে করে হল খোলা যাবে তাহলে তারা সেটি করতে পারে। তবে তারাও আসলে দ্বিধা-দন্দে ভুগছে। একটি সিদ্ধান্ত নিলে তার হিতে বিপরীত হলে তার দায়ভার কেউ নেবে না। সবাই তখন সমালোচনা শুরু করবে। সেজন্য যে কোনো সিদ্ধান্তই ভেবে চিন্তে নিতে হবে।