রোকেয়াতে নেই রোকেয়ার চর্চা
প্রতিষ্ঠার এক যুগ পেরিয়ে তেরো বছর হতে চললেও এখনো ‘রোকেয়া স্টাডিজ’ নামে কোন কোর্স বা রোকেয়া চর্চার কোনো ব্যবস্থা নেই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নামে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নেই তাঁর কোনো স্মৃতি চিহ্ন, দৃষ্টিনন্দন প্রতিকৃতি কিংবা রোকেয়ার স্থায়ী কোনো মূর্যাল। নামের শুরুতে ‘বেগম’ লেখা নিয়েও রয়েছে নানান বিভ্রান্তি। নামে প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রতিষ্ঠানটিতে উপেক্ষিত মহিয়সী এ নারী।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস থেকে জানা যায়, ২০০৮ সালে ১২ অক্টোবর র্সবপ্রথম রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরের গৌরব মহিয়সী নারী রোকেয়ার নামে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বিভিন্ন কারণে অবহেলা করা হয়েছে ‘রোকেয়ার’। বলা যায়, নামেই কেবল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ, প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর আসলেই লোক দেখানো শোভাযাত্রা এবং আলোচনা সভা আর পত্রিকায় ক্রোড়পত্র ছাপিয়েই ‘রোকেয়া দিবস’ পালিত হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে কিংবা অন্য কেনোভাবেই রোকেয়াকে জানার বা বোঝার কেনো সুযোগ নেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। তাদের দাবী, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার এক যুগ পার করে তেরো বছরে পদার্পণ করলো সেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে রোকেয়ার প্রতিকৃতি বা স্থায়ী ম্যুরাল, রোকেয়াকে জানতে পাঠ্যসূচী প্রণয়ন অথবা ‘রোকেয়া স্টাডিজ’ নামে বিভাগ চালু করা।
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মুন-ইমু বলেন, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নারী জাগরণ ও নারীর উঠে আসার জন্য স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে অথচ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সেই নামে কোনো বিভাগ নেই। রোকেয়ার নামে কোনো বিভাগ না থাকায় বাংলা বিভাগের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে মনে করি এটা খুবই দুঃখজনক। নারী জাগরণের জন্য তিনি যে প্রবন্ধ ও রচনাগুলি লিখেছেন তা যদি রোকেয়ার শিক্ষার্থীরা জানতে ও বুঝতে না পারে তবে নারীদেরকে নিয়ে তাঁর যে স্বপ্ন তা বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে। তার সেই সময়ের উঠে আসার গল্প, বিজ্ঞান এবং নারীর উঠে আসা নিয়ে তাঁর যে লেখা তা যদি তার নামের বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যয়ন করার সুযোগ না থাকে তবে তা অজানাই থেকে যাবে বলে মনে করেন বাংলা বিভাগের এই নারী শিক্ষার্থী।
বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নিতাই কুমার ঘোষ বলেন, রোকেয়াকে জানতে ‘রোকেয়া স্টাডিজ’ বিভাগ চালু করার দাবী জানাই। বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রখ্যাত ব্যাক্তিদের জানতে তাদের ম্যূরাল স্থাপন করা হয়েছে। তেমনিভাবে ‘রোকেয়াকে’ জানতে তাঁর ম্যূরাল বা দৃষ্টিনন্দন নামপ্লেট এর কোনো বিকল্প নেই। সিন্ডিকেটে ‘রোকেয়া স্টাডিজ’ বিভাগ চালুর অনুমোদন হলেও এখনো তা চালু না করার পিছনে প্রশাসনের ইচ্ছার অভাবকেই দায়ী করছেন তিনি।
এদিকে নামের শুরুতে ‘বেগম’ লেখা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। তিনি বলেন, “রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নিজের নামের আগে কখনো ‘বেগম’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। বেগম কথাটি ছিলো তৎকালীন অভিজাত মুসলমান নারীদের সম্বোধন সূচক একটি শব্দ। কাজেই রোকেয়ার নামের আগে ‘বেগম’ কথাটির ব্যবহার যথার্থ নয়। একারণে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নাম থেকে ‘বেগম’ কথাটি তুলে দেওয়া রোকেয়াকে সম্মান জানানোর জন্য যথার্থ। কারণ, একটা ভুল নাম এভাবে টিকে থাকতে পারেনা।”
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘রোকেয়া স্টাডিজ’ নামে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল জলিল মিয়ার আমলে একটি ১০০ নম্বরের পাঠ্য বিষয় প্রতিটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের পড়ার জন্য বাধ্যতামূলক করে, যা সিন্ডিকেট সভায় গৃহীত হলেও বিষয়টি চালুর কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর যোগদানের এক বছরের মাথায় ডিনস কমিটির সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১টি বিভাগের সকল শিক্ষার্থীর জন্য এবং ২০১৭-১৮ সেশনে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় সেমিষ্টার থেকে নন-ক্রেডিট এবং বাধ্যতামূলক ‘রোকেয়া স্টাডিজ’ কোর্সটি ক্লাসে পড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও এখন অবধি বাস্তবায়ন হয়নি।
সিন্ডিকেটে পাশ হওয়ার পরেও কেন এখনো পর্যন্ত রোকেয়ার ম্যূরাল কিংবা ‘রোকেয়া স্টাডিজ’ নামে কোন বিভাগ চালু করা হয়নি এবিষয়ে জানতে উপ-উপাচার্য ড. সরিফা সালোয়া ডিনা এবং উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে দীর্ঘদিন থেকে ফোন দিলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।