করোনার প্রভাব

করোনা: চাকরির বাজারে পিছিয়ে পড়ছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি  © ফাইল ফটো

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করছেন শাম্মি আখতার। পত্রিকার পাতায় বিভিন্ন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলেও সেখানে আবেদন করতে পারছেন না তিনি। শাম্মি আশা করছিলেন, এ বছর স্নাতকোত্তর শেষ করে ভালো চাকরি হয়ে যাবে তার। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে তার সেই স্বপ্ন থমকে গেছে। মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা না হওয়ায় অনেক চাকরির আবেদনই করতে পারছেন না তিনি। অথচ শাম্মির সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা তারই বন্ধু আবির দেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করোনার মধ্যেই স্নাতকোত্তর শেষ করে একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করছেন। 

শুধু শাম্মীই নন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ফাইনাল পরীক্ষা না হওয়া লাখ শিক্ষার্থীরা এখন এমন চাকরির আবেদনের সুযোগ হারাচ্ছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি ৭ কলেজে অনার্স কিংবা মাস্টার্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ফাইনাল পরীক্ষা না হওয়ায় চাকরিসহ নানা খাতে পিছিয়ে পড়ছেন তারা। অন্যদিকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষাবর্ষ শেষ করে প্রায় সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে থাকছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ফলে উচ্চশিক্ষায় চরম বৈষম্যের এবং চাকরির বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে সমান সুযোগ না থাকার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। 

শিক্ষা খাতে জড়িতরা বলছেন, করোনায় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বন্ধ থাকলেও চলছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ আবাসিক হলে থাকেন। করোনা সংক্রমন সীমিত রাখার লক্ষ্যে এগুলো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সে অবস্থা নেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বেসকারিগুলোকে ক্লাস পরীক্ষা গ্রহণের অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাবর্ষ সম্পন্ন করতে পারলেও স্বায়ত্ত্বশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা তা পারছেন না। এমন প্রেক্ষাপটে চাকরির নতুন বিজ্ঞপ্তিগুলোতে আবেদন করতে পারছেন প্রাইভেটের শিক্ষার্থী-গ্রাজুয়েটরা। কিন্তু ওই একই বর্ষের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আবেদন করতে পারছেন না। 

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর মধ্য মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। ফলে বন্ধ হয়ে যায় পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা। কিছুদিন বন্ধ রাখার পর অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা নেয়া শুরু করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সেটি বন্ধ করে দেয়। এর কিছুদিন পর ইউজিসির অনুমতি নিয়ে আবারও ক্লাস-পরীক্ষা শুরু করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র ক্লাস কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে থমকে যায় এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন। 

ইউজিসি বলছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কারণেই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চাইলেই শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারে। কেননা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্লাস-পরীক্ষার বিষয় তাদের একাডেমিক কাউন্সিল ঠিক করে। একাডেমিক কাউন্সিল যদি মনে করে তারা পরীক্ষা নেবে তাহলে এখানে ইউজিসিকে জানানোরও প্রয়োজন নেই। তারা পরীক্ষা নিতে পারে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, করোনার কারণে প্রাইভেট-পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে- তার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই দায়ী। কেননা প্রত্যেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত হয়। তাদের ক্লাস-পরীক্ষার বিষয়গুলো একাডেমিক কাউন্সিল ঠিক করে। ফলে পরীক্ষা না হওয়ার কারণে কোনো শিক্ষার্থী যদি চাকরির আবেদন করতে না পারে তাহলে সেই দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই নিতে হবে।

তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস শুরু করতেই ছয়-সাত মাস সময় নিয়েছে। এখনো পরীক্ষার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ফলে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিতে আমাদের কাছে বারবার অনুমতি চেয়েছে। তারা তাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন থমকে যাক- সেটি চায়নি। ফলে তারা এগিয়ে গেছে। 

এদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে পরীক্ষা নিতে পারলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় না পারায় এর তীব্র সমালোচনা করেছেন শিক্ষা খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, পরীক্ষা না হওয়ায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড় বড় কয়েকটি চাকরির আবেদনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি সদ্য প্রকাশিত ৪৩তম বিসিএসেও অনেকেই আবেদন করতে পারবেন না। অথচ বিসিএসের অধিকাংশ ক্যাডারই হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘ আটমাস হয়ে গেলেও এখনো পরীক্ষার আয়োজন করতে না পারায় শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হচ্ছে সেটি পুষিয়ে দিতে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। 

তবে করোনার ফলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে সংকট তৈরি হয়েছে সেটি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। তারা বলছেন, চাকরির বাজারে যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সেটি ঠিক হয়ে যাবে। বড় বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এবং বিসিএসে আবেদন সময়সীমা বৃদ্ধি করলেই তাদের শিক্ষার্থীরা বঞ্চনার হাত থেকে রেহাই পান। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, করোনার কারণে আমাদের ছেলে-মেয়েদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে যারা চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষা দেবেন তাদের ক্ষতিটা সবচেয়ে বেশি। দু:খজনক হলেও সত্য যে করোনার কারণে আমাদের শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারে পিছিয়ে পড়েছে। তবে আমরা বিষয়টি সমাধানের জন্য কি করা যায় সেটি নিয়ে ভাবছি। কোভিড-১৯ এর ফলে যে সমস্যার-সংকটের সৃষ্টি হয়েছে সেটি থেকে উত্তরণে সারা পৃথিবীই চেষ্টা করছে। আমরাও আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। 

চাইলেই পরীক্ষা নেয়া যায় না জানিয়ে ঢাবি উপাচার্য আরও বলেন, অনলাইনে পরীক্ষা নিতে গেলে আমাদের অনেক ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না। তখন তাদের বঞ্চিত করা হবে। আমাদের অনেক শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয় ডিভাইস নেই। ফলে আমরা চাইলেই পরীক্ষার আয়োজন করতে পারি না। আমি সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহবান জানাবো, আমাদের কোনো শিক্ষার্থী যেন চাকরি কিংবা বিসিএসের আবেদন থেকে বঞ্চিত না হয় সেদিকে দৃষ্টি দেবেন। প্রয়োজনে আবেদনের সময়সীমা বৃদ্ধি করারও দাবি জানান তিনি।

করোনার মধ্যে বিসিএস কিংবা বড় বড় চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করাই উচিত হয়নি বলে মনে করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের অনার্স শেষ বর্ষের অর্ধেক পরীক্ষা হয়ে গেছে। অবশিষ্ট পরীক্ষা জানুয়ারিতে নেয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু পুরো বিষয়টিই নির্ভর করছে করোনা পরিস্থিতির উপর। করোনা মহামারী চলার কারণে বিসিএস কিংবা বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করলেই হতো। সবকিছুতে এত তাড়াহুড়া না করাই ভালো।

এদিকে সম্প্রতি শেষ হওয়া প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের আবেদনে অনার্স চতুর্থবর্ষের শিক্ষার্থীরা (করোনা না হলে যদের পরীক্ষা হয়ে যেত) আবেদন করতে পারেননি বলে জানা গেছে। এছাড়া সদ্য প্রকাশিত ৪৩তম বিসিএসের আবেদনও করতে পারছেন না এই সকল শিক্ষার্থী। কেননা ৪৩তম বিসিএসের আবেদন শুরু হবে আগামী ৩০ ডিসেম্বর থেকে। আবেদন শেষ হবে ৩১ জানুয়ারি। এ সময়ের মধ্যে তাদের পরীক্ষা শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে প্রাইভেটের শিক্ষার্থীরা কোনো সমস্যা ছাড়াই আবেদন করতে পারবেন। করোনার কারণে পাবলিকের শিক্ষার্থীরা প্রাইভেটের সমান সুযোগ পাবেন পাবেন না বলে দাবি তাদের।

এ প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমি আর আমার বন্ধু একই বর্ষের শিক্ষার্থী হয়েও আমার বন্ধুর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। অথচ আমি ফাইনাল ইয়ারেই পড়ে আছি। এতে চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার জন্য দ্রুতই উপযুক্ত হয়ে গেছে সে। এভাবে পাবলিক-প্রাইভেটের বৈষম্য তো বাড়ছেই। সে ৪৩তম বিসিএসে আবেদন করবে। অথচ আমি পারব না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান বলেন, ফাইনাল পরীক্ষা না হওয়ায় প্রাথমিকে আবেদন করতে পারিনি। এখন ৪৩তম বিসিএসেও আবেদন করতে পারবো না। অথচ এক সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া আমার অনেক বন্ধুর স্নাতকোত্তর শেষ হয়ে গেছে। কেননা করোনার মধ্যেও তাদের ক্লাস-পরীক্ষা হয়েছে। আর আমরা অনলাইন ক্লাসেই সীমাবদ্ধ। তারা নিজেদের চাকরির জন্য প্রস্তুত করছে। আর আমরা শুধু অপেক্ষার প্রহর গুনছি।


সর্বশেষ সংবাদ