২০ নভেম্বর ২০২০, ০৯:২৭

গৌরবময় পথচলায় ১৮০ বছরে পদার্পণ ঢাকা কলেজের

ঢাকা কলেজ  © টিডিসি ফটো

ঢাকা কলেজ। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ‘নিজেকে জানো’ মূলমন্ত্র ধারণ করে দীর্ঘ ১৭৯ বছরের পথচলায় সময়ের সাথে শিক্ষার আলো বিতরণের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ তৈরির কারখানা হিসেবেই পরিচিত শতবর্ষী এই বিদ্যাপীঠ। ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কলেজটি হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার শিক্ষা বিস্তারের মূল কেন্দ্রবিন্দু। শুধু ঢাকা নগরীই নয় এই উপমহাদেশের বিদ্যারণ্যে প্রবীণ এক বৃক্ষের নাম ‘ঢাকা কলেজ’।

১৮৬৬ সালে ঢাকায় কর্মরত ইংরেজ জয়েন্ট কালেক্টর আর্থার লয়েড ক্লে’র লেখা ‘Principal Heads of the History and statistics of the Dacca Division’ নামক এক প্রতিবেদনে ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে চমৎকার তথ্য পাওয়া যায়। তাঁর লেখা এই প্রতিবেদনটি পরবর্তী ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয় -

“The COLLEGE OF DACCA

Founded by the British Government of India, for the instruction of the native youths of the Eastern Districts of Bengal in European literature and Science.

The first stone of the edifice is laid by the Right Reverend Daniel, Lord Bishop of Calcutta, and Metropolitan of India.

On the 20th day November, A.D. 1841, in the reign of Her most Majesty.”

অর্থাৎ এখানে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠার তারিখ হিসেবে ২০ নভেম্বরের কথাই উল্লেখ আছে। ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার বিশপ রেভারেন্ড ড্যানিয়েল ঢাকা কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও ঐ ভবনের নকশা করেছিলেন কর্নেল গ্যাসটিন। খাঁটি ব্রিটিশ ঢঙ আর বিলাতি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আদলে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানটি পালন করা হয়।

তবে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠার পটভূমিও বেশ চমৎকার। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইংরেজরা ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এতদঞ্চলের শাসকে পরিণত হয় তাঁরা। ইংরেজরা নিজেদেরকে শাসক হিসেবে পরিচয় না দিলেও ১৭৭২ সালে গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস এই মুখোশ খুলে দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে সরাসরি এ দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। পরবর্তী ৬২ বছর পর্যন্ত তাঁরা এই অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এত দীর্ঘ সময়ে এই অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা ঐতিহ্যগতভাবেই চলছিলো।

এরপর ১৮২৮ সালের ২০ আগস্ট রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। রামমোহন রায়ের ধর্ম প্রচারে অনেকেই এতে আকৃষ্ট হয়।

মানুষের এই আগ্রহ দেখে ১৮৩০ সালে সরকার এক শিক্ষানীতি গ্রহণ করে। পরবর্তীকালে ১৮৩৫ সালে ২০ এপ্রিল দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ ‘জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (General Committee of Public Instruction) লর্ড বেন্টিকের নিকট একটি প্রতিবেদন পেশ করে। প্রতিবেদনটিতে ইংরেজি সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য যতগুলো সম্ভব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। এই প্রতিবেদনের হাত ধরেই ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই থেকে বুড়িগঙ্গার তীরে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ‘ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী’ যেটি বর্তমানে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত।’ শিক্ষা-দীক্ষায় তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে তৎকালীন সিভিল সার্জন ড. জেমস টেইলর ও ঢাকা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মি. গ্রান্টের ভূমিকা ছিলো প্রশংসনীয়। দীর্ঘ প্রচেষ্টায় এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে সমাজের সামগ্রিক চিত্র বদলে যেতে থাকে।

পাশ্চাত্যের কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান এবং দর্শন বিষয়ে জ্ঞান লাভের পথ উন্মুক্ত হয় এদেশের মানুষের মাঝে। মানুষের ব্যাপক আগ্রহ আর সাড়া দেখে ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী স্কুলকে একটি কলেজে বা একটি আঞ্চলিক উচ্চতর ইংরেজী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়। যার নাম দেয়া হয় ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ বা সংক্ষেপে ঢাকা কলেজ।

এরপর ঢাকা কলেজের জন্য নির্মাণ করা হয় কার্জন হল। ভিক্টোরীয় স্থাপত্যরীতি, মোগল স্থাপত্যশৈলী আর বাংলার স্বতন্ত্র সংবেদনশীল বৈশিষ্ট্য নিয়ে তৈরি এই ভবনটি ১৯০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সম্রাজ্যের প্রতিনিধি ভাইসর লর্ড কার্জন ঢাকায় এসে এর উদ্বোধন করেন।

১৯০৮ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ওই বছরই ঢাকা কলেজ কার্জন হলে অভিবাসিত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা কলেজ তার সর্বস্ব দিয়ে ঠাঁই নেয় পুরাতন হাইকোর্টের লাট ভবনে (বর্তমান সুপ্রীমকোর্টে)।

১৯৩৯ সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সশস্ত্র সেনারা হাইকোর্ট ভবন দখল করে তাঁবু হিসেবে ব্যবহার করে। ১৯৪৩ সালে ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট কলেজের (বর্তমান কবি নজরুল কলেজের মূল ভবনে) কিছুদিন অস্থায়ীভাবে কার্যক্রম চালায়। এর অল্পদিন পরেই ফুলবাড়িয়া স্টেশন সংলগ্ন সিদ্দিকবাজারে খান বাহাদুর আবদুল হাইয়ের মরচে ধরা পুরাতন দালানে কার্যক্রম শুরু করে।

১৯৫৫ সালে তার আপন গৃহের সন্ধান পায় ঢাকা কলেজ। স্থায়ী ঠিকানা হয় মিরপুর রোড, ধানমন্ডি ঢাকা-১২০৫ এ। সে সময়ে ঢাকা কলেজের আয়তন ছিল ২৪ একর। তবে স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের সময় ৬ একর জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয় ঢাকা কলেজকেল বর্তমানে ঢাকা কলেজের মোট জমির পরিমাণ ১৮ একর।

১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠার পর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং হিন্দু কলেজের শিক্ষক জে. আয়ারল্যান্ডকে ঢাকা কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হয়। তিনি ১৮৪১ থেকে ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এই তিন ধরনের শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। ইতিহাসের অন্যতম এই বিদ্যাপীঠে ১৯৭২ সালে ৬টি বিষয়ে স্নাতক কোর্স শুরু হলেও এখন ১৯ টি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর বিষয়ে পাঠদান করা হয়৷

১৮৪১ সালে পথচলা শুরুর পর ১৮৫৯-৬০ সালে কলেজের ছাত্রসংখ্যা ৫২ জনে দাঁড়ায়। ১৯১৭-১৮ সালে তা ৯৯৫ জনে গিয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার।

২৫০ জন শিক্ষক আর প্রায় ১৯০ কর্মচারী মিলিয়ে ঢাকা কলেজ যেন রাজধানীর বুকে এক চিলতে ভালবাসার পরশ দিয়ে কাছে ডেকে নেয়।

বর্তমানে ঢাকা কলেজের ছাত্রাবাসের সংখ্যা ৮ টি। এসব ছাত্রবাসে কত যে দেশ বরেণ্য মানুষের বসবাস ছিলো তার সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন।

দক্ষিণ ছাত্রাবাসের ২০৬ নং কক্ষ। এই কক্ষে থেকেই উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন দেশবরেণ্য খ্যাতিমান লেখক হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক ‘চিলেকোঠার সেপাই’ খ্যাত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ থেকে ৪ জানুয়ারি ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। এই লেখকের স্মরণে নির্মিত হয়েছে ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাত্রাবাস’।

‘পশ্চিম ছাত্রাবাস’ স্থাপিত হয় ১৯৬৪ সালে। এই ছাত্রাবাসে শুধু সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীদের বসতি। পাশেই রয়েছে ‘আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস’। এই ছাত্রাবাস একটা বিশেষ কারণে বিখ্যাত। এই ছাত্রাবাসের দ্বিতীয় তলায় ২০৯ নং কক্ষে নিজের শিক্ষাজীবন কাটিয়েছেন মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল কাইয়ুম।

আরেক ছাত্রাবাসের নাম ‘শহীদ ফরহাদ হোসেন ছাত্রাবাস’। শহীদ ফরহাদ সম্পর্কে জানা যায়, তিনি ছিলেন ১৯৯১-৯২ সেশনে দ্বাদশ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। ১৯৯২ সালের ২৫ আগস্ট নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেটে ঘাতকরা নির্মমভাবে ফরহাদকে হত্যা করে। তাঁরই স্মরণে নামকরণ করা হয় এই ছাত্রাবাসের। এছাড়াও উত্তর ছাত্রাবাস, দক্ষিণায়ন ছাত্রাবাস ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে শেখ কামাল ছাত্রাবাস।

পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশে রয়েছে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী এবং সামাজিক সংগঠন। ঢাকা কলেজ রোভার স্কাউট গ্রুপ, ঢাকা কলেজ সাংবাদিক সমিতি, বিএনসিসি, রেড ক্রিসেন্ট, ঢাকা কলেজ অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব, বিজনেস ক্লাব, ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, ডিবেটিং সোসাইটি, সায়েন্স ক্লাবসহ আরও অনেক সংগঠন।

দেশ ও জাতির দুর্দিনে ঢাকা কলেজ দুঃশাসনের মরণ-যন্ত্রনা আর কষ্ট সংগ্রামকে ধারণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাজপথে। ১৯৩৯-৪৫ সালের বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪১ সালের দোল দাঙ্গা, ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তথা শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনে এই কলেজের ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল অগ্রভাগে।

১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঢাকা কলেজের ৮ ছাত্র শহীদ হয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া এই ৮ বীরকে শ্রদ্ধায় জড়িয়ে রাখতে মূল ভবনের প্রবেশদ্বারের বাম পাশে দেয়ালে পাথরখচিত স্মৃতিফলক রাখা আছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদ আ. ন. ম নজীব উদ্দিন খান খুররম এর নামে ঢাকা কলেজের মূল অডিটোরিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে। শহীদদের প্রতি সম্মান ও তাঁদের স্মৃতি অমলীন রাখতে পর্যায়ক্রমে আবাসিক হলসমূহের নাম এই বীর শহীদদের নামে নামকরণ করা হবে বলেও জানায় কলেজ প্রশাসন।

সময়ের সাথে সাথে ১৭৯ বছরের পথচলায় ঐতিহ্য গৌরবের ঢাকা কলেজ। অনেক কাঁটাযুক্ত আর বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে ১৮০ বছরে পদার্পণ করেছে কলেজটি। কালের আবর্তে দুই শতাব্দীর কাছাকাছি চলে এসেছে এই প্রতিষ্ঠান। মেধাবীদের পছন্দের তালিকায় এখনও শীর্ষে ঢাকা কলেজ। অতীতের মতো এখনও দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বে এই কলেজের ছাত্ররাই। গৌরবের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখবে আগামী প্রজন্মও এমনই আশাবাদ।