ছয় মাসের সেমিস্টার এক বছরে, আট বছরেও শেষ হচ্ছে না অনার্স
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এণ্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগে ছয় মাসের সেমিস্টার শেষ করতে সময় লাগছে এক বছর। এতে চার বছরের অনার্স কোর্স শেষ করতে শিক্ষার্থীদের লেগে যাচ্ছে প্রায় আট বছর। অনার্স শেষ করতেই চাকরীর বয়স শেষ হয়ে যাওয়ায় হতাশায় ভুগছেন তারা। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা বিভাগের শিক্ষকদের কোনো পদক্ষেপ নেই বলে অভিযোগ করছেন দীর্ঘ সেশনজটে থাকা শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এই দীর্ঘ সেশনজটের মূলে রয়েছে বিভাগটির শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর ব্যক্তিস্বার্থ। নিজের প্রমোশন আটকে থাকার কারণে পরীক্ষার একবছর পরেও নিজের আয়ত্ত্বে থাকা কোর্সের খাতা এবং নাম্বার জমা দেয়নি বিভাগের শিক্ষক। তাদের রাজনীতির ক্ষোভ বিভাগে তুলেন বলেও অভিযোগ করেছেন তারা।
এদিকে, কেন এই দীর্ঘসূত্রীতা এ নিয়ে শিক্ষকদের সাথে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীরা কথা বললে নানানভাবে হুমকি এবং হয়রানীর মুখে পড়েন তারা। বিভাগীয় প্রধানের সাথে বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকদের সামঞ্জস্যতা নেই বলেও অভিযোগ তুলেছেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অধিকাংশ সময় একজনই বিভাগীয় প্রধান এবং তিনি অন্য বিভাগের হওয়ায় বিভাগ সম্পর্কে তেমন ভূমিকা রাখতে পারেননি এমনকি বিভাগের অন্য শিক্ষকেরাও এতে ক্ষুব্ধ হয়ে দায়সারাভাবে বিভাগ পরিচালিত হচ্ছে।
এ নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসাকে জানান, ‘শিক্ষার্থীরা যা অভিযোগ করেছে তা সব সত্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান সংকটের পাশাপাশি বিভাগেও অভ্যন্তরীণ অনেক সংকট রয়েছে। তারমধ্যে শিক্ষক সংকটও অন্যতম।’
এ শিক্ষক বলেন, কম্পিউটার সায়েন্স এণ্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ হলেও বিভাগীয় প্রধান পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের। তিনি অন্য বিভাগের হওয়ায় এই বিভাগ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ করতে পারেননি। ঠিকভাবে প্লানিং কমিটি করা হয়নি। বিভাগের প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারেননা। বিভাগে অন্য কোনো অধ্যাপক না থাকায় নিয়মানুযায়ী একজন অধ্যাপকই বারবার বিভাগীয় প্রধান হচ্ছেন।
তিনি আরো বলেন, একাডেমিক কাজে শিক্ষকদের সমন্বয়হীনতা এবং দীর্ঘদিন বিভাগের একাডেমিক মিটিং না হওয়ায় পরিকল্পনা মাফিক কোনো কাজ হচ্ছেনা। এদিকে বায়ান্ন লক্ষ টাকার ল্যাব ইকুইপমেন্ট দীর্ঘদিন স্টোরে পড়ে থাকলেও ল্যাব সেটাপ দিচ্ছেনা। প্রয়োজনীয় ল্যাব না থাকাও এই সেশনজটের একটি কারণ। বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কখনো কোনো ধরণের কনফারেন্স বা একাডেমিক মিটিং হয়নি। এছাড়াও করোনাকালে নির্দিষ্ট কোনো দিক নির্দেশনাও নেই যেখান থেকে শিক্ষার্থীদের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে অনলাইনে বা অন্য কোনো মাধ্যমে সেশনজট নিরসনের ব্যবস্থা করা হবে।
২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ২০০৯ সালে চালু হওয়া কম্পিউটার সায়েন্স এণ্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ১০ জন শিক্ষক (২ জন শিক্ষা ছুটিতে) ও পর্যাপ্ত শ্রেণীকক্ষ থাকলেও চার বছরের অনার্স সম্পন্ন করতেই লেগে যাচ্ছে আট বছর। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগে ধীরে ধীরে সেশনজট মুক্ত হচ্ছে সেখানে এই বিভাগে দিনদিন লাগামহীনভাবে বাড়ছে সেশনজটের মাত্রা। বিভাগটির এপর্যন্ত ১২টি ব্যাচের মধ্যে মোট ৫টি ব্যাচ বের হয়েছে এবং চলমান ব্যাচ সংখ্যা ৭টি।
বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের যে শিক্ষার্থীরা এই বিভাগে ভর্তি হয়েছেন তারা তিন ভিসির আমল দেখলেও অনার্স সম্পন্ন করতে পারেনি এখন পর্যন্ত। বিশ্বদ্যিালয়ের ৬ষ্ঠ ব্যাচের এই শিক্ষার্থীরা এখনো অষ্টম সেমিস্টারে। অথচ নিয়মানুযায়ী এতোদিনে মাস্টার্স শেষ হওয়ার কথা ছিলো। একই দশা এই বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের। ৬বছরে এসেও ৬ষ্ঠ সেমিস্টারের ল্যাব এখনো শেষ করতে পারেনি তারা। যেখানে মাস্টার্স শেষ হওয়ার কথা ছিলো।
২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ৫ম সেমিস্টারে। এদের মাস্টার্স চলার কথা থাকলেও এখনো অনার্স শেষ করতে পারেনি। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের ৮ম সেমিস্টার চলার কথা থাকলেও তারা এখনো চতুর্থ সেমিস্টারে। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া নবম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা তৃতীয় সেমিস্টারে যদিও এদের চলার কথা ছিলো ৬ষ্ঠ সেমিস্টার। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের এগারো তম ব্যাচ চতুর্থ সেমিস্টারে থাকার কথা থাকলেও তারা এখনো দ্বিতীয় সেমিস্টারে।
হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে ওই বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, তিন ভিসির আমল দেখলাম তবুও অনার্স শেষ হয়নি। তিনবছর সেশনজটে থাকার পরেও অনার্স শেষ না হওয়ার ফলে কোনো ধরণের চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছেননা তারা।
বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দফতর জানায়, এক বছরে দুটি সেমিস্টার (জানুয়ারি-জুন এবং জুলাই-ডিসেম্বর) মিলিয়ে একটি শিক্ষাবর্ষ শেষ হবে। এক সেমিস্টারের মেয়াদ ছয়মাস হওয়ায় সাড়ে চারমাসের মধ্যেই সমস্ত ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, মিডটার্ম এবং প্রেজেন্টেশন শেষ করে পরবর্তী ছয় সপ্তাহের মধ্যেই ফলাফল প্রকাশ করবেন কিন্তু বেশিরভাগ বিভাগের শিক্ষকেরা এই নিয়মের তোয়াক্কা করেননা।
এ নিয়ে বিভাগটির সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আবু কালাম মো. ফরিদ উল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বর্তমানে বিভাগটি বিভাগীয় প্রধান শূন্য। উপাচার্য নিজেই বিভাগীয় প্রধান হয়ে আছেন। আমি বিভাগীয় প্রধান থাকাকালীন বিভাগের সেশনজট নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম এরমধ্যে করোনার প্রভাব তা হতে দেয়নি।
পূর্বে থেকে কেন এতো সেশনজট এ বিষয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতিকেই দায়ী করেন। তবে শিক্ষকদের মধ্যে অন্তঃকোন্দলের বিষয়টিকে তিনি উপেক্ষা করেন। নতুন বিভাগীয় প্রধান বা বিভাগের একাডেমিক কোন সিদ্ধান্ত কেমনে হচ্ছে সে বিষয়ে তিনি বলেন, আমি বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব শেষ করেছি এখন এ ব্যাপারে আর কোন কিছুই ভাবতে চাইনা।
এ বিষয়ে জানতে বিভাগীয় প্রধান (দায়িত্বে) উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে বারবার ফোন দিলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।