করোনার বন্ধে ক্যাম্পাস আগলে রেখেছেন যারা
প্রতিদিন হাজার হাজার প্রাণের পদচারণায় মুখরিত হতো যে প্রাঙ্গন সেখানে আজ শুধুই নিস্তব্ধতা। যেখানে প্রতিদিন স্পন্দিত হতো হাজার শিক্ষার্থীর হৃদয়ের কথামালা, আবেগ, অনুভূতি আর স্বপ্নের ঢেউ সে স্থান আজ পরিণত হয়েছে এক গভীর শূণ্যপুরে। একুশ শতকের এই আধুনিক যুগে এমন দীর্ঘ ঘরবন্দি পরিস্থিতি দেখতে হবে তা হয়তো আধুনিক পৃথিবীর কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
তবে বাস্তবিক অর্থে পরিস্থিতি ঢের ভিন্ন। কল্পনারও ঊর্ধ্বে করোনার ভয়াল থাবায় এমন পরিস্থিতিতেই আটকে গেছে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ প্রায় ৯ মাস ধরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর ক্লাসরুম থেকে শুরু করে খেলার মাঠ, ক্যাফেটেরিয়া, ক্যান্টিনসহ ক্যাম্পাসের জমজমাট জায়গাগুলো সম্পূর্ণ ফাঁকা। জনমানবহীন এমন পরিস্থিতির ব্যাতিক্রম নয় ইতিহাস ঐতিহ্যের বিদ্যাপীঠ রাজধানীর ঢাকা কলেজও।
উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণীর প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর ক্যাম্পাস ঢাকা কলেজ। ১৮ একরের এই সবুজবীথি জুড়ে প্রতিদিনই শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি তৈরি করতো প্রাণচাঞ্চল্য। ছুটির দিনগুলোতেও আটটি হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের সরব কোলাহলে পূর্ণ থাকতো ক্যাম্পাস। তবে করোনার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দীর্ঘ সময় জুড়ে শিক্ষার্থীশূন্য ক্যাম্পাস জুড়েই তৈরি হয়েছে নীরবতা।
বর্তমানে শর্তসাপেক্ষে বিশেষ প্রয়োজনে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ক্যাম্পাসে প্রবেশে অনুমতি থাকলেও করোনার প্রাথমিক অবস্থায় ছিলো প্রচন্ড কড়াকড়ি। এমন অবস্থায় সেই মার্চ মাস থেকে আজ অবধি শিক্ষার্থী ও কোলাহল শূণ্য ক্যাম্পাসের হল, ক্লাসরুম সহ পুরো ঢাকা কলেজ সযত্নে আগলে রেখেছেন নিরাপত্তা প্রহরীরা।
এছাড়াও উচ্চমাধ্যমিকের ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হবার পর থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পুরোদমে চলছে অফিসিয়াল বিভিন্ন কার্যক্রম। এছাড়াও শূন্য হল গুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট হল তত্বাবধায়ক শিক্ষকরাও অবস্থান করছেন সংশ্লিষ্ট হলগুলোতে। দীর্ঘদিন শিক্ষার্থী শূন্য ক্যাম্পাসে কেমন আছেন? এমন প্রশ্নে আবেগতাড়িত হয়েছেন শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সহ সবাই।
কলেজের প্রবেশপথ দুইনাম্বার পকেট গেইটে দায়িত্ব পালন করছিলেন নাজির আহমেদ, জয়দেব হালদার, শাহ আলমসহ কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী। জরুরি কাজে কলেজে আগত শিক্ষার্থী এবং দর্শনার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতেও তদারকি করতে দেখা যায় তাদের। নিরাপত্তাকর্মী নাজির আহমেদ বললেন— শিক্ষার্থী বিহীন ক্যাম্পাসে মন টেকে না।
ছাত্রদের ‘মামা’ ডাক খুব মিস করি। সবসময়ই মনে হয় চারদিকে একটা শূন্যতা বিরাজ করছে। আবার সবকিছু ঠিক হয়ে যাক এমন প্রত্যাশা করি। ক্যাম্পাসের কর্মচারীদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের কাছে আরেকজন প্রিয় মুখ শহীদ মিয়া। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি ‘শহীদ মামা’ নামেই বেশ পরিচিত। বললেন— ২৬ বছর ধরে ঢাকা কলেজের বাস চালাই কিন্তু এত দীর্ঘ সময় শিক্ষার্থীদের থেকে দূরে থাকিনি। প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের কলেজে নিয়ে আসা আবার ক্লাস শেষে গন্তব্যে পৌঁছানোর মাঝে যে আনন্দ ছিলো দীর্ঘদিন ধরে সে আনন্দ নেই। ছাত্ররা হৈ-হুল্লোড় করে গাড়িতে চলাচল করতো, সবাই মামা বলে ডাকতো সবকিছুই মনের মধ্যে কষ্টের সৃষ্টি করে। মাঝেমধ্যে বাসগুলোর কাছে যাই। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করি। মনে চায় সবাইকে নিয়ে আবারো আগেরদিনে ফিরে যাই। আবাসিক হল গুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়করাও করোনার এই মহামারিতে হল ছেড়ে যাননি৷
উত্তর হলের তত্ত্বাবধায়ক ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওবায়দুল করিম বলেন, করোনাকালীন সময়ে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও হলের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে হলে অবস্থান করে নিয়মিত তদারকি করছি। শিক্ষার্থীদের পদচারনায় মুখরিত হলগুলোর নিস্তব্ধতা আমাদের মনে বিষন্নতার সৃষ্টি করে। আশা করি সুস্থ পরিস্থিতিতে আবারও শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হবে ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস।
আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস হলের তত্বাবধায়ক ও পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আলতাফ হোসাইন বলেন, শিক্ষার্থী বিহীন নিরব হল গুলো আমাদের স্মৃতির মানসপটে দুঃখবোধ জাগ্রত করে। শিক্ষার্থীরা যেভাবে তাদের জিনিসপত্র রেখে বাড়িতে গিয়েছে ফিরে এসেও ঠিক এমনটিই যেনো পায় তা নিশ্চিতে প্রতিদিন আমি নিজে হলের প্রতিটি রুম পর্যবেক্ষণ করি। নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দিয়ে হলের চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করি যেনো হলের বন্ধ রুম গুলো মশার আখড়ায় পরিণত না হয়। আমরা প্রত্যাশা করি যেন খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যেই আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। আবারো সবাই সুন্দরভাবে ফিরে আসুক ক্যাম্পাসে। কারণ শিক্ষার্থীর পদচারণা বিহীন ক্যাম্পাস শূন্য মরুভূমির মতো।