ভর্তি পরীক্ষা সশরীরে হলে এইচএসসি কেন নয়?
করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবের কারণে এ বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা না নিয়েই পরীক্ষার্থীদের সনদ দেবে সরকার। যদিও করোনা পরিস্থিতি অনেকটা একই রকম থাকলেও সশরীরে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখন প্রশ্ন উঠছে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হলে এইচএসসি পরীক্ষা কেন নেওয়া হয়নি।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একাত্তর সালের মতো প্রেক্ষাপটেও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ছাড়া সনদ দেওয়া হয়নি। এখন উন্নত বিশ্ব কিংবা ইংলিশ মিডিয়ামের উদাহরণ টেনে বিনা পরীক্ষায় সনদ দেওয়া হচ্ছে। অথচ ইংলিশ মিডিয়ামে ক্লাস টেস্টসহ নানা মূল্যায়ন করা হয়। যেটি আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই। তারা বলছেন, প্রয়োজনে পরীক্ষা সংখ্যা কমিয়ে হলেও এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া উচিৎ ছিল।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনেকে বলছেন একাত্তর সালে পরীক্ষা নেওয়া হয়নি, এটা মিথ্যা কথা। আমাদের ওই পরীক্ষা পরে নেওয়া হয়েছিল। সরকার কী কারণে এমন সিদ্ধান্ত নিল, জানি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হলে এইচএসসি পরীক্ষাও নেওয়া সম্ভব ছিল।
জানা গেছে, গত ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারির কারণে তা স্থগিত হয়ে যায়। করোনার প্রাদুর্ভাব না কমায় চলতি মাসের শুরুর দিকে এ পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর ফলে এইচএসসিতে বসা প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে সবাই পাস করবে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরকার এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারবে না, তাই সরকার এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করেছে। অন্যদিকে, বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সশরীরে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার কথা বলছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এ পরীক্ষা নেয়া হলে কোন সমস্যা থাকবে না।
তিনি বলেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে মূল্যায়ন ছাড়াই ভর্তির কোন সুযোগ নেই। তাই স্বাস্থ্যবিধির কথাটি মেনেই পরীক্ষাটি নিতে হবে। তার মতে, এইচএসসিতে পরীক্ষার্থীর সংখ্য প্রায় ১৪ লাখ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় একত্রে এতো সংখ্যক অংশগ্রহণ করবে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নুর বলেন, ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে স্বায়ত্তশাসিত ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। বাকিরা এখনও পরিস্থিতি বিবেচেনা করছে। করোনা সংক্রমণের কারণে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারলো না, আর সেই কারণে সশরীরে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হলে সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে থাকবে।
তিনি বলেন, কোন যুক্তিতে এই রিস্কটা নেবে বিশ্ববিদ্যালয়? পরীক্ষা দিতে এসে যদি কেউ করেনায় আক্রান্ত হয়, সেটা দায়িত্ব কি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় নেবে? আর যদি নিতে পারে তাহলে সশরীরে ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারে।
রাজধানীর স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের অভিভাকদের সংগঠন ‘অভিভাবক ঐক্য ফোরামের’ সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি ভর্তি পরীক্ষা নেয়া উচিত। তবে দেশে করোনা পরিস্থিতি কি পর্যায়ে যাবে, সেটি বিবেচনা করেই এই পরীক্ষাটি নেয়া উচিত। তখন যদি বেড়ে যায়, তাহলে দুইমাস পরেও নিতে পারে।
তিনি বলেন, উচ্চশিক্ষায় প্রবেশে ভর্তি পরীক্ষার কোন বিকল্প নেই। যেহেতু এবার করোনার কারণে এইচএসসি হয়নি আর করোনার মধ্যে যদি বিশ্ববিদ্যায় ভর্তি নেয়া হয় তাতে যদি কোন পরীক্ষার্থী করোনা আক্রান্ত হয় তাহলে তার দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেই নিতে হবে। শিক্ষার্থীরা এইচএসসিতে কি অর্জন করেছে সেটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। তাই আমরা চাই ভ্যাকসিন আসার পরই এই পরীক্ষা নেয়া হোক।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, সবকিছু মিলেয়ে অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার মতো সক্ষমতা আমাদের নেই, সেটি আমার মনে হয়। অন্যদিকে, ভালো কিছু চাইলেতো রিস্কতো নিতেই হবে। তবে সশরীরে কেউ পরীক্ষা দিতে আসলে করোনা আক্রান্ত হলে তার দায়ভার ওই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিতে হবে। তারপরও সবার পরামর্শে আমরা একটি জায়গাতে আসতে পারবো। এক্ষেত্রে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে সহযোগিতা করতে হবে।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা অনলাইনে হবে, নাকি সরাসরি হবে- তা নিয়ে ইউজিসি এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। আগামী ২৯ অক্টোবর এ নিয়ে ইউজিসি নিজেরাই বসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশকয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে সশরীরে পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আগে থেকেও নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিত। তারা কখনও বলেনি যে, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তারা আসবে।
অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে এক প্রশ্নে অধ্যাপক আলমগীর বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ এ বিষয়ে ইতোমধ্যে আলোচনার জন্য একটি চিঠি দিয়েছে। যাতে এ ব্যাপারে ইউজিসি উদ্যোগে নেয়। তবে সেই সভার তারিখ এখনও ঠিক হয়নি বলে জানান তিনি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) মোঃ আব্দুল্লাহ আল হাসান চৌধুরী বলেন, কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সুপারিশ এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা বাতিলের বিষয়টি নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় ব্যাখাও দিয়েছেন। তাই বিষয়টি নিয়ে আমাদের আর কোন বক্তব্য নেই।
ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, করোনার সংক্রমণের মধ্যে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়াটা খুবই কষ্টসাধ্য ছিলো। চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি মাথায় নিয়ে সারা দেশে বৃহৎ পরিসরের এই পরীক্ষা নিতে সংশ্লিষ্টের বেশ সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছিলো। সেজন্যই পরীক্ষার নেওয়ার চিন্তা থেকে সরে আসা হযেছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কিছু বিশ্বিবদ্যালয় সশরীরে ভর্তি পরীক্ষা নেবার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটা বাস্তবসম্মত। কেননা এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিশ্বিদ্যালয় চাইলে ইউনিট ভিত্তিক আলাদাভাবে বৃহৎ পরিসরে পরীক্ষা নিতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেবার মতো সক্ষমতা রয়েছে কিনা তা আগেই সংশ্লিষ্টদের নিশ্চিত করতে হবে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক যতীন সরকার মনে করেন, এইচএসসি পরীক্ষা না নিয়ে অটোপাসের সিদ্ধান্ত মোটেও সমীচীন হয়নি। এমন সিদ্ধান্ত দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় ভবিষ্যতেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলেও মনে করছেন তিনি।
তিনি বলেন, শতভাগ স্বাস্থ্য বিধি মেনে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হলেও পরীক্ষা নেওয়াটা প্রয়োজন ছিলো। কেননা এইচএসসি পরীক্ষা প্রতিটি শিক্ষার্থীদের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এইচএসসি পরবর্তী বিশ্বিবদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও মূল্যায়ন পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এব্যাপারে আর নতুন কিছু বলার নেই। তাই সমৃদ্ধ আগামীর জন্য মূল্যায়নভিত্তিক শিক্ষার্থী ভর্তি কোন বিকল্প নেই।