ঘরবন্দি শিক্ষার্থীদের ভাবনায় ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস
- মোঃ রাকিবুল হাসান তামিম
- প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২০, ১২:৩৬ PM , আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২০, ০১:১৩ PM
গত বছরের ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ চীনের উহান শহরে প্রথম করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের খবর প্রকাশিত হয়। প্রাথমিক অবস্থায় যখন এটি ছড়িয়ে পরে তখনো অনেক দেশ ব্যাপারটিকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। আসলে মানুষ ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেনি যে সেই ভাইরাসটি পরের কয়েক মাসের মধ্যে পুরো পৃথিবীকে বিপর্যস্ত আর পুরো ওলট পালট করে দেবে। পরবর্তীতে যখন পুরো পৃথিবী জুড়ে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা দুটোই বাড়তে থাকে, তখন প্রায় প্রতিটি দেশ বিভিন্ন রকম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে থাকে।
তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারি নির্দেশে ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয় দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সর্বক্ষেত্রেই দেয়া হয় লকডাউন। পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে সবকিছু খুলে দেওয়া হলেও এখনো বন্ধ রয়েছে দেশের সকল পর্যায়ের স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়। যে প্রাঙ্গনে প্রতিনিয়ত মিলিত হতো হাজার প্রাণের স্পন্দন, হৈ হুল্লোড় আর কোলাহলে মুখরিত থাকত চারিদিক, সে প্রাঙ্গন জুড়ে আজ অবধি ৪ মাস ১১ দিন ধরে কেবলই দীর্ঘ নিস্তব্ধতা আর নিরবতা বিরাজ করছে।
এই দীর্ঘ সময় ধরেই ঘরবন্দি সময় কাটাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ঘরবন্দি সময়ে কি ভাবছেন প্রিয় ক্যাম্পাসকে নিয়ে? এমন প্রশ্ন ছিলো রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে। যেখানে জমজমাট ক্লাস, আড্ডা, গানে মুখরিত ছিলো ১৮ একরের সবুজ ক্যাম্পাস। সেখানেই আজ নিঃশব্দের আনাগোনা। করোনাকালীন সময়ে ঘরবন্দি স্মৃতিকাতর শিক্ষার্থীদের প্রিয় ক্যাম্পাস ঢাকা কলেজকে নিয়ে ভাবনা জানাচ্ছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস প্রতিনিধি মোঃ রাকিবুল হাসান তামিম
ঢাকা কলেজ অনেকের কাছে যেমন স্বপ্নের জায়গা, আমার কাছেও তাই! ২০১৩ সালে প্রথম পা রাখা, এর আগে কখনো আসা হয়নি,শুধু নাম শোনা হয়েছে। তারপর ২০১৫ তে ভর্তির মাধ্যমে নতুন জীবনে প্রবেশ। যে জীবনে মানুষ অতিবাহিত করে তার জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময়। আর তাই ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস আমার অন্য এক জীবন, অন্য এক অনুভূতি! মাঝেমধ্যে ভাবতাম! খুব ভাবতাম। পড়াশোনার শেষে যখন এই ক্যাম্পাসটা ছাড়ব, যখন পাশে এই পাগলাটে বন্ধুগুলো থাকবে না, তখন বুকের ভেতর কত হাহাকার খেলে যাবে! কতটা শূন্য লাগবে আমার দুনিয়া আর একা লাগবে নিজেকে! একসময় আর ভাবতে পারি না। বুকের বাঁ পাশটায় ব্যথা করে। কেমন চিনচিনে একটা ব্যথা!
সেই ব্যাথাতুর ভাবনা গুলোকে করোনা কেমন যেন সত্যি করে দিল। কতদিন প্রাণের ক্যাম্পাস থেকে দূরে! সেই ক্লাস রুম, গ্যালারি, অডিটোরিয়াম, কলেজ মাঠ, পুকুরপাড়, ক্যাফেটেরিয়া, টেনিসগ্রাউন্ড, সাউথ, নর্থ, সাউদার্ন হল, সাংবাদিক সমিতির অফিস! সব কি আগের মতই আছে??হয়ত সবই আগের মত,শুধু মিষ্টি মধুর কোলাহল আর প্রাণের মানুষগুলো নেই।
এখন আর ছুটি মনে হয়না, মনে হয় কারাবাস! এই কারাবাসে যদিও আমার পরিবারের সাথেই সময় কাটছে। অধিকাংশ সময় অনলাইনে সোশ্যাল মিডিয়া আর ফেসবুক ইউটিউব এবং ঘুম।এতে করেই চরম ভাবে বিষিয়ে উঠছি। ধৈর্য তার সীমা অতিক্রম করে মাঝে মাঝে প্লাবিত করে দিয়ে যায় মনের ভেতরটায়।
যখন এই প্রাণের ক্যাম্পাসটাতে থাকব না; প্রতিটা মিনিট, প্রতিটা সেকেন্ড মিস করব। কিন্তু সবকিছু থেকেও না থাকার কষ্টের অনূভুতি আরো নিদারুণ। বন্ধুরা, খুব মিস করছি তোদের, তোদের আড্ডা আর বেসুরো গানের জমজমাট আসরটাকে আর সবচেয়ে বেশি প্রাণের ক্যাম্পাস ঢাকা কলেজকে ।
ঢাকা কলেজ আমার ভালবাসার জায়গা। ঘরবন্দী এই সময়ে নিরবে নিভৃতে ভাবি সেই সোনালী দিনগুলোর কথা। যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিলো তখন ক্যাম্পাসের বন্ধুরা সবাই মিলে যখন পুকুরপাড়ে বসে বাদাম খেতাম আর দূষণ মুক্ত বাতাস অনুভব করতাম কি প্রশান্তির সুখ মনে ছেয়ে যেত তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। পুকুরপাড়ে বসলে মনটা জুড়িয়ে যেত। মাঠের পূর্ব পাশে গাছের ছায়ায় বসে মাঠের খেলা দেখাটা আরো বেশি মিস করছি। বিজয় চত্তরে, টেনিস গ্রাউন্ডে, হলের মাঠে, শহীদ মিনারে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর মাঠের সবুজ ঘাসের উপর বসে গ্রুপ স্টাডিটাও বেজায় মিস করি।
আসলে কি ঢাকা কলেজ এমন একটা জায়গা যেখানে প্রবেশ করলে বুকটা গর্বে ফুলে উঠে। হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত সেই ক্যাম্পাস আজ কোলাহল মুক্ত। দেখা হয় না আমাদের প্রিয় শিক্ষকদেরকে যাদের থেকে আমরা মহামূল্যবান শিক্ষা গ্রহণ করছি। প্রিয় শিক্ষকদের বকুনি খুব মিস করি। আর ক্যান্টিনের সিংগাড়া, ডিমখিচুড়ির কথা না হয় আর নাই বললাম। বাসায় রান্না করা সুস্বাদু খিচুড়িটাও যেন ক্যান্টিনের খিচুড়ির কাছে হার মেনে যায়। প্রত্যাশা করি পৃথিবীর সুস্থ হয়ে উঠবে। আবার আমরা সবাই আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরে যাব। দেখা বন্ধুদের সাথে, বড় ভাই, ছোট ভাই এবং আমাদের শিক্ষকদের সাথে এই আশা নিয়ে বুক বেঁধে বসে আছি।
আমার কাছে যদি জানতে চাওয়া হয় এই মুহুর্তে কেমন কাটছে আমার করোনা কালীন সময়? তাহলে আমি বলবো , মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা করে চিৎকার করে বলে উঠি, থাকবো না আর বদ্ধ ঘরে, দেখবো আবার জগৎটারে। কারণ অদৃশ্য এক ভাইরাসের সংক্রমণে ঘরবন্দি আমরা সবাই।
বলতেই হয় দৃশ্যমান শত্রুর থেকে অদৃশ্য শত্রু দুর্বল হলেও তা দৃশ্যমান শত্রুর থেকে বেশি ক্ষতিকর। আর এই ক্ষতির লাগাম টেনে ধরতেই লক ডাউন।
প্রায় দীর্ঘ চার মাসের বেশি সময় ধরে রীতিমত এক অনিশ্চিত সময়ের স্রোতে পুরো পৃথিবী। এই অনিশ্চয়তার দোলাচালে ঘরবন্দি সময়ে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে সবুজবীথি প্রিয় ক্যাম্পাসকে। দীর্ঘ এই ছুটিতে এমনি দুরবস্থা যে ঠিক হিসেব করে বলা কঠিন যে কতটা মিস করছি ঢাকা কলেজকে। সেই সাথে আলাদা চিন্তা করতে হচ্ছে সেশন জটের ভয়াবহতা নিয়ে। এছাড়াও ছোট খাটো উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া, আয়ের উৎস প্রশমিত হওয়া, বন্ধু মহলের সাথে দীর্ঘদিন সাক্ষাৎ না হওয়া, আড্ডা ঘোরাঘুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া, সবমিলিয়ে যেন এক কয়েদী জীবনের ছাপ।
বাস্তবিক অর্থে এই বিষয় গুলো খুব যে স্বস্তির নয় তা সহজেই অনুমেয়। স্বাভাবিক সময়ের ক্লাস, ক্লাস টেস্ট, ইয়ার ফাইনাল ইত্যাদি ইত্যাদি নানাবিধ দৈনন্দিন কাজকর্মের সময় গুলো যে খুব বেশি স্বস্তির ছিল তাও না। তবে ব্যস্ততার জীবনে অনিশ্চয়তার অন্ধকার, আলো হয়ে জন্মায়। আর সেটাই জীবনের প্রত্যাশা। আর প্রত্যাশার জায়গায় যখন অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তখন খুব বেশি ভাল থাকার সুযোগ থাকে না।
তারপরো যা নিবারণ করা যায় না, তা মানিয়ে নেওয়াই শ্রেয়। এই উক্তির উপর ভিত্তি করেই নিজের মত করে চেষ্টা করছি ভাল থাকার, ভাল রাখার। সামাজিক দুরুত্ব মেনে টুকটাক বের হচ্ছি বিশেষ প্রয়োজনে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আগামী শিক্ষা জীবন নিয়ে আলোচনা করছি সহপাঠী বন্ধুদের সাথে।
তারপরও পুকুর পাড়ে বসে আড্ডা, বন্ধুমহলে বিতর্ক, মাঠের খেলাধুলা, ক্লাস সর্বোপরি স্বাভাবিক সময় কলেজ ক্যাম্পাসে কাটানো সময় গুলো খুব মিস করছি। সবকিছুর মধ্যেও সৃষ্টিকর্তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা যিনি আমাকে এখন অবধি সুস্থ রেখেছেন। আমি আশাবাদী অচিরেই আমরা এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করবো আর এই দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের পরিমন্ডল তথা পরিবেশ প্রকৃতির উপর যত্নশীল হবো।
ঢাকা কলেজ আমার স্বপ্নের ঠিকানা। এসএসসি পরীক্ষার পর থেকেই ঢাকা কলেজের আঙিনায় পা রাখার স্বপ্নে বিভোর থাকতাম। সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে এইচএসসিতে ঢাকা কলেজে ভর্তি হবার মাধ্যমে স্বপ্নের সারথি’তে পা রাখি। সবুজঘেরা রূপ-লাবণ্যে আকৃষ্ট হই খুব। ক্যাম্পাসে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তেই কি এক অনাবিল আনন্দ উল্লাসে ছেয়ে যেত হৃদয়। ক্যাম্পাসে আমার সবচেয়ে ভালোবাসার জায়গা পুকুর পাড়। সেখানে বসলেই যেন মনে হয় এক অকৃত্রিম অকৃপণ মায়াবী বাতাসের জাল হৃদয়ের খোরাক জোগায়। এছাড়াও বন্ধুদের সাথে আড্ডা, ক্লাস, খেলাধুলা, দলবেঁধে বন্ধুদের নিয়ে ক্যান্টিনের সিঙ্গাড়ার বা খিচুড়ি খাওয়ার রোজকার নিয়মটাই আমার হৃদয়ে ভালোবাসার সঞ্চারিত করে।
যা বললাম সে আমার সোনালী অতীত! এই করোনাময় বদ্ধ জীবনে খুব মিস করছি কলেজের সোনালী সেই সময়গুলো। মিস করছি প্রিয় শিক্ষকদের কড়া শাসন আর ভালোবাসার বন্ধনকে। একা নিভৃতে ভাবি কবে ফিরবো আবার প্রাণের ক্যাম্পাসে? আবার কবে সব শিক্ষার্থীদের কোলাহল আর হৈচৈ মুখরিত হবে ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গন? আবার কবে দলবেঁধে মাঠে খেলতে নামবো? আবার কবে স্নিগ্ধ শীতল পুকুর গা ভেজাবো?
প্রত্যাশা একটাই সুস্থ হয়ে উঠুক গোটা পৃথিবী। মৃত্যু আর অনিশ্চয়তার বাঁধ ঘুচে আনন্দ আর সমৃদ্ধির সোপান এগিয়ে আসুক। আবারো আমরা যেন ফিরে আসি প্রিয় ঢাকা কলেজের প্রাঙ্গনে। মুখরিত হবে ক্যাম্পাস আনন্দের গানে।
করোনার এই সংকটময় মুহূর্তে বদ্ধ জীবনে ক্যাম্পাসে কাটানো প্রতিটা ক্ষণই স্মৃতির মানসপটে ভেসে উঠে। ঢাকা কলেজে ভর্তি হবার পর থেকে মিরপুর থেকে কলেজ বাসে আসা-যাওয়া করতাম। যার দরুণ ক্লাসমেটদের পাশাপাশি আমার বাসমেটদের সাথেও বন্ধুত্বের স্বরূপ তৈরি হয়। আর ক্লাসের আগে অথবা পরে পুকুর পারে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া কখনো মিস হতো না।
ক্যান্টিনেই অধিকাংশ সময় সকালের নাস্তা করতাম। এখনো চোখ বন্ধ করে সেসব স্মৃতি হাতরে বেড়াই। স্মৃতিকাতরতায় বিভোর হয়ে যাই। তবে প্রযুক্তির কল্যাণে বন্ধুদের খোঁজ-খবর রাখা অথবা অনলাইন আড্ডা এখনো জমে বেশ তবে ক্যাম্পাসের পুকুরপাড়ের আড্ডার মতো হয় না। সুস্থ পৃথিবীর স্বস্তির নিঃশ্বাসে আবারো ফিরবো প্রাণের ক্যাম্পাস ঢাকা কলেজে এমন প্রত্যাশাই সকল শিক্ষার্থীর মনে প্রাণে। আবারো ক্লাস, আড্ডা, গানে মুখরিত হবে প্রিয় ক্যাম্পাসের আঙ্গিনা।ততদিন ভালো থাকি আমরা সবাই, ভালো থাকুক প্রিয় ক্যাম্পাস ঢাকা কলেজ।