এ মুহূর্তে অনলাইনে পাঠদানের বিকল্প নেই, তবে....
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের প্রকোপের মধ্যে গত মার্চের মাঝামাঝি থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র সেশনজটের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন যেন ব্যাহত না হয় সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ( ইউজিসি) শুরু থেকেই অনলাইন ক্লাসের পরামর্শ দিয়ে আসছে। সেই পরামর্শ মেনেই দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলতি মাস থেকে পুরোদমে অনলাইন ক্লাস শুরু করেছে। তবে গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেটের ধীর গতি, শিক্ষার্থীদের আর্থিক অসচ্ছলতা, অনেকের স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ না থাকায় অনলাইন ক্লাসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, এসব সমস্যার সমাধান করে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটালে অনলাইন ক্লাসও সফলতার মুখ দেখতে পারবে। শিক্ষার্থীদের ভাবনায় অনলাইন ক্লাসের বাস্তবতা, সীমাবদ্ধতা ও উত্তরণের সম্ভাব্য উপায় তুলে ধরেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সোহেল রানা—
অনলাইনে ক্লাস নেয়ার সিদ্ধান্ত যেমনই হোক না কেন এর বাস্তব প্রেক্ষাপট আসলে ভিন্ন। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা এখন গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আছেন যেখানে ঘন্টাব্যাপী অনলাইনে ক্লাস করা দুষ্কর। ক্লাসের কার্যকারিতা কতটা হবে তার আগে বিবেচ্য বিষয়। এই ক্রান্তিলগ্নে চড়া মূল্যে ইন্টারনেট কিনে ব্যবহারের সক্ষমতাও সবার নেই। ডিভাইস সংকট তো আছেই। গ্রামে মোবাইল নেটওয়ার্কও সঠিকভাবে পাওয়া যায় না।
অনলাইনে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে পেশাগত কাজে আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি সার্ভে করেছিলাম। মোট ৮৯৪ জন শিক্ষার্থীর ১২৩ জন অনলাইন ক্লাসের ব্যাপারে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছে। বাকি সবাই ‘না’ ভোট দিয়ে নানান সমস্যার কথা জানিয়েছেন। গত সপ্তাহে আমাদের ব্যাচের ২টি অনলাইন ক্লাস হয়েছে সেখানে ৬৫ জন শিক্ষার্থীর মাত্র ২০ জন উপস্থিত ছিল। ক্লাসের শেষ পর্যন্ত ছিল ১১ জন। অধিকাংশ বিভাগের চিত্র প্রায় একই। সুফল পেতে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারনেট খরচ ও ডিভাইস প্রদান করতে হবে।
শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছিল সমস্যাগুলো সমাধানে ইউজিসি হয়তো ফান্ড দিবে কিন্তু তেমন কোন পদক্ষেপ দেখিনি। প্রতি সেমিস্টারে শিক্ষার ব্যয় নির্বাহ করে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এখন এই দুর্যোগে কিভাবে তাদের সাথে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবে তার ব্যয়ভার নিশ্চয়ই শিক্ষার্থীরা বহন করবে না। বিশ্ববিদ্যালয়কেই বহন করতে হবে। ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীও অনলাইন ক্লাসের আওতায় নেই। তাই এই ক্লাসের কোন কার্যকারিতা আছে বলে মনে হয় না। ডিভাইস সংকট ও ইন্টারনেট খরচের অভাবে যারা অনলাইনের আওতায় নেই তাদের প্রতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বৈষম্য করা হয়েছে।
—মো. শফিকুল ইসলাম, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে প্রায় চার মাস বন্ধ আছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার মধ্যেও শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন ক্লাস শুরু করার জন্য পরামর্শ দিয়ে আসছে। মেধাবী সন্তানদের শিক্ষার বাতিঘর হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরা যেন সেশনজটে না পড়েন, তাঁরা যেন পড়াশোনার মধ্যে থাকেন, এসব চিন্তা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় অনলাইন ক্লাস চালু করার পক্ষে মত দেন। যার প্রেক্ষিতে ১ জুলাই থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম চালু হয়।
কিন্তু অনলাইন ক্লাসে সকল শিক্ষার্থী ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। যারা অংশগ্রহণ করতে পারছে না তাদের পড়াশোনার মনোবল ভেঙে যাচ্ছে। আমরা শিক্ষার্থীরাও আমাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে শঙ্কিত এবং আমরা নিজেরাও বুঝতে পারছি যে করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাসের কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু গ্রামাঞ্চলের ধীরগতির ইন্টারনেট সেবা,আর্থিক অসচ্ছলতা, অনেকের কাছে স্মার্টফোন না থাকা এবং মানসিক দুশ্চিন্তাসহ বিভিন্ন কারণে আমরা অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে পারছিনা। এসব সমস্যার উত্তরণ করে যদি নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা উন্নত করা যায়, ফোরজি নেটওয়ার্ক সুবিধা প্রান্তিক এলাকায় পৌঁছে দেয়া যায়, প্রতিটা শিক্ষার্থীর জন্য মাসিক এমবি খরচ সরবরাহ হয়। তাহলে অনলাইন ক্লাস জনপ্রিয়তা পেতে পারে। এছাড়া শিক্ষা উপকরণ- পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড, গবেষণা প্রবন্ধ/বইয়ের অধ্যায় হিসেবে ই–মেইল বা ফেসবুক ক্লোজ অফিশিয়াল গ্রুপে বা ইউটিউব চ্যানেলে দেয়া যেতে পারে।
পরিশেষে বলব, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সরকার সকলেই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই অনলাইন ক্লাস কিংবা শিক্ষা কার্যক্রমের কথা ভাবছি। এই ভাবনা হতে হবে সুদূরপ্রসারী। অনলাইন যেসব অসুবিধা এখন সামনে আসছে, এই অসুবিধা দুর করতে পারলে শুধু শিক্ষা প্রসার লাভ করবে না বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ডিজিলাইজেশনেও এক ধাপ এগিয়ে যাবে।
—আনামুল হক, লোক প্রশাসন বিভাগ, ৩য় বর্ষ
দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সরকার কোনোভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে শিক্ষার্থীদের বিপদের মধ্যে ফেলতে চাচ্ছে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেশনজট এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন দীর্ঘায়িত না হয় তার জন্য অনলাইন ক্লাস চালু করে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ও অনলাইন ক্লাস চালু হয়। অনলাইন ক্লাস চালু হওয়ার মাধ্যমে অনেকে আশার আলো দেখছে, অনেকে আবার হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে অনলাইন ক্লাস কতটা কার্যকরী হচ্ছে?
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকার কারণে অনেকেই ইন্টারনেটজনিত সমস্যায় পড়ছে। বাসায় নেটওয়ার্কের স্পীড না পাওয়ার ফলে মাঠে, রাস্তায়, বাড়ির আঙ্গিনায় গিয়ে ক্লাস করতে হচ্ছে এবং বৃষ্টি হলে বৃষ্টিতে ভিজেও অনেকে ক্লাস করে। অনেক শিক্ষক গ্রামে চলে যাওয়ার কারণে তারাও ঠিকমতো নেটওয়ার্ক স্পীড পাচ্ছেনা। তাই বারবার ডিসকানেক্ট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া অডিও, ভিডিও ভালো বোঝা যায় না। যার ফলে পঠিত বিষয়টি বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। তাই যদি ক্লাস লেকচার ভিডিও রেকর্ড করে ফেসবুক বা ইউটিউবে দেওয়া হয় তাহলে যারা ক্লাস করতে পারছে না তারা পরবর্তীতে লেকচারটা পাবে তাতে তাদের আর হতাশায় পড়তে হবেনা।
তাছাড়া অধিকাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবার থেকে আসা যাদের অনেকের স্মার্টফোন নেই এবং বর্তমানে ইন্টারনেটের চড়া মূল্যের কারণে তাদের পক্ষে ডাটা ক্রয় করে ক্লাস করা সম্ভব না। তাদের জন্য ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোনের ব্যবস্থা করা এবং সকল শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারিভাবে বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারনেটের প্যাকেজের ব্যবস্থা করা এবং মফস্বল এলাকায় ইন্টারনেটের স্পীড নিশ্চিত করা তাহলে মনে হয় অনলাইন ক্লাস সুদূরপ্রসারি হবে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য কল্যাণকর হবে।
—মো. কামরুল হাসান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত শিক্ষার্থীরা, অধিকাংশ শিক্ষার্থী তাদের পরবর্তী জীবন নিয়ে চিন্তিত। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি চিন্তিত তাদের সাথে জড়িত বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষক (প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, গ্রাজুয়েশন)। কিভাবে কি করলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় এই নিয়ে দিনরাত ভাবনায় ডুবে আছেন তারা। অধিকাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে সময় কাটায় বলেই শিক্ষকশ্রেনী তাদের শিক্ষা-কার্যক্রম অনলাইনে পরিচালনা করতে ইচ্ছে পোষণ করেন।
কিন্তু দেখা যায় শিক্ষকদের অনেকেই জানেন না কিভাবে তারা অনলাইনে শিক্ষা দিবে। সাম্প্রতিক দেখা যায় অধিকাংশ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন পাঠদান শুরু করেছে বিভিন্ন আ্যাপ ব্যবহার করে। বর্তমান সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে অনলাইনে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রম চালাতে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হচ্ছে।
সবচেয়ে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়ে নেটওয়ার্ক সমস্যা। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্যন্তঅঞ্চলে ঠিকমতো সিম কার্ডের নেটওয়ার্ক পাওয়াটাই দুষ্কর। দেশের অনেক গ্রামে ঠিক মতো কথা বলার জন্য নদীর পাড়, গাছের উপরে বসে কথা বলতে হয়। এর মধ্যে অনলাইনে শ্রেণি পাঠদান চালানো অনেক শিক্ষার্থীর জন্য সমস্যা। তার উপর বিভিন্ন সীম কোম্পানির ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গেলে গুনতে হয় অনেক টাকা, এই করোনার সময়ে অনেক শিক্ষার্থীর টিউশন নেই। তাদের কাছে অনলাইন পাঠদান অনেকটা বিলাসিতার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি পরিবারই চায় তার সন্তান শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠুক, কিন্তু যার সংসার চালানোর জন্য অর্থ সম্পদ নেই সে কিভাবে পাঠদানের অংশ হবে?
—ইমরুল কায়েস, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ