১৬ জুলাই ২০২০, ২১:০৬

সবকিছু স্বাভাবিক হোক, ফিরে আসুক জীবন্ত পৃথিবী

  © টিডিসি ফটো

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। শিক্ষার্থীরা হয়েছেন ঘরবন্দী। ঘরবন্দী করোনায় সকলেরই নানান স্মৃতি। নিত্য নতুন অনুভূতি আর অভ্যাস। পুরনো সব অভ্যাস বদলেছে পৃথিবীর এই দুঃসময়ে এসে; সবার মাঝেই বৈরিতা।

সারাবছরই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুরন্তপনার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ প্রস্ফুটিত হয়। তবে করোনায় সব টালমাটাল; বেশ পরিবর্তন এসেছে নিত্যদিনের সব কাজকর্মে। দেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে তাদের দিনলিপি জানাচ্ছেন মামুন সোহাগ।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজে শেষ বর্ষে পড়ছেন রিফাত খোন্দকার ইমন। করোনার দুর্দিনে বাসায় থেকেই সময় পার করছেন। উষ্মা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমি ভেবে পাচ্ছিনা ঠিক কি লিখবো! প্রতিদিন কাজের রুটিন এক থাকেনা। কোনোদিন ক্লাসের পড়া পড়ি, কোনোদিন বিসিএসের জন্য, কোনোদিন আবার উপন্যাস। হঠাৎ বাইরে চলে যাই কোনোদিন। ঘুরে ঘুরে ফটোগ্রাফি করি কিছু সময়। আবার কিছুদিন একদম খেয়ে ঘুমিয়ে সিনেমা দেখেই কেটে যাচ্ছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সুমাইয়া রিতু বলেন, ‘চলছে করোনা মহামারী, আবদ্ধ সবাই চার দেয়ালের মাঝে। সত্যি কথা বলতে পার করা সময়গুলো একদম সুখকর নয়।বাসায় খুব অলস সময় কাটছে। তবে পরিবারের সাথে কাটানোর জন্য অফুরন্ত সময় পেয়েছি আর সেটাই কাজে লাগাচ্ছি। আম্মুর সাহচর্যে থাকি বেশিরভাগ সময়। এছাড়া ছবি আঁকতে ভালোবাসি এজন্য মাঝে মাঝে মনটা আঁকিবুঁকিতে লাগায়।পড়াশোনা টুকিটাকি করি, নতুন রেসিপি তৈরি করি আর আম্মুর বকুনি খাই, বাসায় কিছু ফুল গাছ লাগিয়ে সেগুলোর পরিচর্যা, মায়ের কাজে সাহায্য করা, বোনের সাথে খুনসুটি ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে ফোনটা একটু বেশিই সঙ্গী হয়েছে। এভাবেই কেটে যাচ্ছে দিন রাত। আবারো খুব শিগগির ফিরে যাবো সেই ব্যস্তময় দিনগুলোতে এই কামনায় করি।আল্লাহ সব স্বাভাবিক করে দিক, ফিরে আসুক জীবন্ত পৃথিবী।’

রাজধানীর ইডেন কলেজের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী মালিহা কলি। হল ছেড়ে বাড়িতে গেছেন মাস চারেক। তিনি বলেন, ‘করোনাকালীন সময়ে সকল শিক্ষার্থী নিজ বাসায় অবস্থান করছে। যেহেতু সোশ্যাল ডিসটেন্সের তাগিদে বাসা থেকে বের হবার কোন সুযোগ নেই সেহেতু বন্দি অবস্থাটা খুব বেশি উৎফুল্লময় হচ্ছে না। মেয়েদের ক্ষেত্রে মাকে সাহায্য করা, রান্না করা, বই পড়া মোটকথা পরিবার ও নিজেকে সময় দিয়ে কাটানো হচ্ছে। অনলাইন ক্লাসের ও একটা ব্যাপার আছে, গুটিকয়েক শিক্ষার্থী অনলাইনে পড়ালেখার ব্যাপারে সিরিয়াসনেস প্রকাশ করে হাই সিজিপিএর বন্দোবস্ত করছে। অনিশ্চিত ভবিতষ্যতের ব্যাপার আরো অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে!’

তেঁজগাও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের নুসাইবা ইসলাম রিতি। গ্রামের বাসা গাজিপুরে আছেন করোনার লম্বা ছুটির কারণে। তিনি বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেই সাথে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ। সেই কারণে এখন আমরা শিক্ষার্থীরা ঘরেই বন্দী। এখন আমার অবসর কাটছে সপ্তাহে তিনদিন জুম অ্যাপে ক্লাস করে। এছাড়াও যেহেতু বাসা থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না, তাই বাসায় বসেই সময় কাটাচ্ছি। কখনো ছবি আঁকছি, কখনো গল্পের বই পড়ছি, আবার কখনোবা শখের বসে কাপড়ে নকশা করছি। আর ভার্চুয়াল ভাবে বন্ধুদের সাথে ভিডিওকলে আড্ডা দেয়া, আর স্টাডি নিয়ে গ্রুপ আলোচনাতো আছেই। এর মধ্যেও সবথেকে বেশি স্বস্তি পাচ্ছি পরিবারের সকলের সাথে সময় কাটিয়ে। এভাবেই সময় কাটছে।’

বগুড়ায় গ্রামের বাড়িতে আছেন তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থী অন্তুর ইভান। বিরক্তি নিয়ে তিনি বলেন, ‘করোনা বাংলাদেশে হানা দেওয়ার পর থেকেই ঢাকা ছেড়েছি, সেই সাথে ছাড়তে হয়েছে ভালোবাসার ক্যাম্পাস।শুরুতে দিনগুলো খুব অন্যরকম কাটছিল। মনে হচ্ছিলো কতদিন পর সবাইকে পেয়েছি, সব প্রিয় মানুষগুলো একসাথে। এক অন্যরকম অনুভূতি। সেই কলেজ লাইফ থেকেই বাবা-মাকে ছেড়ে; নিজের বাড়ি ছেড়ে থাকছি। সেজন্য হয়তো প্রথম প্রথম দিনগুলো ছিল একদমই অন্যরকম ও ভালোলাগার। কিন্তু এভাবে কিছু দিন চলার পর কেমন যেন মনে হচ্ছিল। কিছু কিছু জিনিস খুবই মিস করছি। মিস করছি প্রিয় ক্যাম্পাস, আমার ভালোবাসার বন্ধুদেরকে। যাদের ছাড়া জীবন যেন জীবন মনে হয় না। তাদের সাথে একবেলা নিয়ম করে আড্ডা না দিলে মনে হয় আমার বোধহয় খাবার হজম হয় নাই। আবার মাঝে মাঝে একটুখানি মিস করছিলাম সেই ব্যস্ত শহর ঢাকাকে।

তিনি বলেন, সেই চিরচেনা জ্যাম হাজারো মানুষের ভিড় হাজারো যানবাহনের ভিড়। আর এই অলস দিনগুলো কাটছে যেন একেকটা দিন একেক রকম করে। মাঝে মাঝে নিজেই বুঝি না কিভাবে চলছে জীবন। কোন দিন হয়তো দুপুর বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেওয়া আবার কোনদিন হয়তো সারারাত বই পড়ে বা মুভি দেখে। কিছুদিন হলো আবার বিকেল করে কিছুক্ষণ ফুটবল ও খেলছি। আবার কোনদিন হয়তোবা বাসা থেকে বের হওয়াটাই হচ্ছে না। এভাবেই কাটছে আমার অলস সময় আর পাড়ি দিচ্ছি আমার লকডাউনের বেকার জীবন।’

দাপুটে ব্যবস্থায় ঢাকাতে সময় পার করেন ইমরান হোসাইন; পড়ছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। নানা আশা বুকে চেপে তিনি বলেন, ‘গ্রীষ্মকালে যখন চারিদিকে প্রচুর রৌদ্রতাপ বিরাজ করে তখন প্রত্যেকে এক পশলা বৃষ্টির আশা করে। যেনো প্রকৃতি আবার তার নিজের সতেজ রূপ ফিরে পায়। কিন্তু তাই বলে এটা নয় যে এক পশলা বৃষ্টির পরিবর্তে সেই বৃষ্টিই কালরূপ ধারণ করে প্রকৃতিকে ভাসিয়ে দেবে। তেমনি ছাত্রজীবনে পড়াশোনা, ক্যাম্পাস, টিউশনি আড্ডাবাজির মধ্যে ২-৪ দিনের ছুটে পাওয়া মানেই প্রিয়জনদের কাছে ছুটে যাওয়া। ঠিক সেভাবেই বাড়িতে এসেছিলাম। সাথে সাথেই দেশে আঘাত হানলো করোনার ভয়াল থাবা। সবাইকে সুরক্ষা ও নিরাপদ রাখার জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ হলো ১৫ দিনের জন্য।কিন্ত সেই ১৫ দিন রূপান্তরিত হয়ে হয়েছে ৪ মাস।

তিনি আরও বলেন, প্রতিদিনেই বাড়ছে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা, সাথে মৃত্যুর মিছিল। চিরচেনা সেই বিদ্যাপীঠ আর ভালোবাসায় রাঙানো কাছের মানুষ গুলোকে দেখি না অনেক দিন। কিন্তু আজ ঘরে বসে এই সোনালী অতীত মনে করা ছাড়া আর কিছুই করার নাই আমাদের। প্রতিক্ষণেই একটা ভয় হৃদয়কে কুরে খায় প্রিয়জনদের,সাথে আবার দেখা হবে কিনা! কিংবা প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরে আবার সবাইকে পাবো কিনা! আবার সেই রঙিন, উৎসবমুখর দিন ফিরে পাবো কিনা। বাড়িতে এইভাবে আর কতদিন থাকা যায়। পরিবারের ছোট খাটো কাজ, আর সময় কাটানোর জন্য একটু বই পড়া, ফেসবুক। তবুও সুদিনের অপেক্ষায় দিন গুনছি। এই কামনায় করি সারাক্ষণ পৃথিবী দ্রুত সুস্থ হোক। সবাই ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক।’