০৭ মে ২০২০, ১২:৪৯

জিন্নাহ থেকে তিতুমীর কলেজ: ছাত্র আন্দোলনে এক মূর্ত প্রতীক

আজ ৭ মে। ৫২ পেরিয়ে ৫৩ বছরে পা দিলো শিক্ষার্থীর সংখ্যায় এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান সরকারি তিতুমীর কলেজ। বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থীর মুখরিত এই ক্যাম্পাসের রয়েছে সুদীর্ঘ গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস।

তিতুমীর কলেজের ইতিহাস:
সময়টা ১৯৬২। ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মাঝামাঝি সময়। বিভিন্ন দাবি আদায়ে প্রায়ই গর্জে উঠছে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ। হামিদুর রহমানের শিক্ষা কমিশন ছিলো ছাত্র সমাজের এই প্রতিবাদী ভাষা রোধ করতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিফলন। তাই তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে যায় এদেশের ছাত্রসমাজ। গর্জে উঠে পূর্ব পাকিস্তান। ছাত্র আন্দোলনে ভীত হয়ে তখনই ছাত্রদের বিভক্ত করতে পরিকল্পনা করে পাকিস্তান সরকার। তারই ধারাবাহিকতা ১৯৬৮ সালে ৭ মে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের ডিগ্রী শাখাকে আলাদা করে নিয়ে আসা হয় মহাখালীর ডিআইটি খাদ্য গুদামে। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নামে নাম দেয়া হয় জিন্নাহ কলেজ।

শুরুতে জিন্নাহ কলেজ নামে শুরু করলেও ১৯৭১ এর উত্তাল মার্চের শুরুতেই এদেশের ছাত্রসমাজ মুছে ফেলে স্বৈরাচারী পাকিস্তানের স্মৃতি।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান রেডিও-টেলিভিশনে এক ভাষণে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি স্থগিত ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশের ছাত্রদের ন্যায়ে ফুঁসে উঠে জিন্নাহ কলেজের ছাত্ররাও। জিন্নাহ কলেজ শাখার ছাত্র সংসদের প্রথম সহ-সভাপতি (ভিপি) সিরাজউদ্দৌলার নেতৃত্বে টিপু মুনশি ও শাহাবুদ্দিনসহ তৎকালীন কতিপয় ছাত্রনেতা প্রতিক্রিয়া হিসেবে জিন্নাহ্ কলেজের সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলেন। তখন আনিসুজ্জামান খোকন (জিন্নাহ কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক) জিন্নাহ কলেজের নাম ‘তিতুমীর কলেজ’ প্রস্তাব করেন।

২ মার্চ ছাত্রলীগের কর্মীরা মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় জড়ো হলে সেখানে তৎকালীন ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রবের মধ্যস্থতায় জিন্নাহ্ কলেজের নাম ‘তিতুমীর কলেজ’ হিসেবে চূড়ান্ত হয়। ওই রাতেই ‘তিতুমীর কলেজ’ নামকরণের সাইনবোর্ড লেখা হয় এবং দেয়ালে টাঙিয়ে দেয়া হয়। তখন এলাকার কিছু যুবকও তিতুমীর নামকরণের ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা করেন।

উত্তাল মার্চের শুরুতে তিতুমীর কলেজের ছাত্রদের এই প্রতিবাদী ভূমিকা স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছিলো আশপাশের মানুষদের।

বর্তমানে তিতুমীর কলেজ:
প্রতিষ্ঠার সময় কলেজটিতে ডিআইটি খাদ্য গুদামের ভবনে শুধুমাত্র উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীতে ক্লাস নেয়া হত। তবে বর্তমানে এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রায় ২৩টি বিষয়ে স্নাতক সম্মান এবং স্নাতোকত্তর শ্রেণীর শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। রয়েছে দুইশোর উপরে অভিজ্ঞ শিক্ষক। যারা বর্তমান গুণগত শিক্ষার চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। বর্তমানে কলেজটিতে রয়েছে একাধিক একাডেমিক ভবন (আরো দুটি ভবন নির্মাণাধীন), বিশাল খেলার মাঠ, অডিটরিয়াম, লাইব্রেরি, মসজিদ, মন্দির, ছাত্র সংসদ কক্ষ, নিজেস্ব জিমনেসিয়াম, কমনরুম, ৩টি আবাসিক হল (আরো দুটি নির্মাণাধীন) ও শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য ৫টি বাস। এছাড়াও রয়েছে একাধিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন। যা শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

তিতুমীর কলেজের গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস স্মরণ করে কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আশরাফ হোসেন বলেন, ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সৃষ্টি হওয়া তিতুমীর কলেজ শুরু থেকে দেশে উচ্চ শিক্ষা চাহিদা পূরণ করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। শুরুতে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম চললেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সুনামের সাথে দেশের উচ্চ শিক্ষাকার্যক্রমে ভূমিকা রেখেছে কলেজটি। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়ে শুধুমাত্র স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মানের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসে এ কলেজের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। এই কলেজেরই প্রথম ভিপি সিরাজউদ্দৌলা স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হন। এছাড়াও আরো অগণিত শিক্ষার্থী দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

তিনি আরো বলেন, বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাবান্ধব নীতি ও পদক্ষেপের অংশ হিসেবে কলেজটিতে নিমার্ণ হচ্ছে দুটো ভবন ও দুটো আবাসিক হল, এছাড়াও পরিবহনেও যুক্ত হয়েছে একটি বাস। যা কলেজের শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে এবং শিক্ষার্থীদের আবাসিক ও পরিবহন সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব করেছে।

এ সময়ে দেশের শিক্ষাখাতে কলেজটির অবদান স্বীকার করে কলেজের সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি ভবিষ্যতে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আরো সুনামের সাথে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ভূমিকা রাখাবে বলে আশা ব্যক্ত করেন। এছাড়াও বর্তমান করোনা মহামারী থেকে সবাইকে সাবধানে থাকার আহ্বান জানান।