২৭ জানুয়ারি ২০২০, ০৯:৪৬

রাবিতে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মাণে বড় অনিয়ম

লোগো

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) 'শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক' নির্মাণে বড় অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি। স্মৃতি ফলকে এক হাজার ৪০০ কেজি তামার পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র ৪৯২ কেজি। সময়মতো হিসাব দেয়া হয়নি অর্থ দপ্তরকে। এ ধরনের বিভিন্ন অস্বচ্ছতা ও অনিয়মের কথা তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে।

জানা যায়, ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫৯তম সিন্ডিকেট সভায় শহীদ তিন শিক্ষক হবিবুর রহমান, মীর আব্দুল কাইয়ুম ও সুখরঞ্জন সমাদ্দার স্মরণে একটি বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মাণের সিদ্ধান্ত পাস হয়। স্মৃতিফলকটির নির্মাণ প্রস্তুতিকল্পে ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মুশফিক আহমদকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মিজানউদ্দিনের প্রশাসন। ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি তৎকালীন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহানকে স্মৃতিফলক নির্মাণ কাজের সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই বছরের ৬ আগস্ট ১১ সদস্যের একটি নির্মাণ কমিটি করা হয়। যার প্রধান ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম।

স্মৃতিফলক নির্মাণ কাজের শুরু থেকে কমিটির বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। একইসঙ্গে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নামে তৈরি হলেও এতে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। যেখানে তিন বুদ্ধিজীবীকে ওপরে এবং মূল নকশার বাইরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রিলিফ ভাস্কর্য বাঁ দিকে তুলনামূলক নিচে স্থাপন করা হয়। এরপর থেকেই বঙ্গবন্ধুকে অবমাননাসহ এটি নিয়ে আরও বিতর্ক শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭৩তম সিন্ডিকেট সভায় ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহানের প্রশাসন। সম্প্রতি তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্মৃতিফলক নির্মাণের জন্য ২০১৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭০তম সিন্ডিকেট সভায় ৮২ লাখ ৬৫ হাজার ১৬১ টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে স্মৃতিফলকের জন্য খোলা ব্যাংক হিসাবে ৭৬ লাখ ৫৮ হাজার ৯১৫ টাকা জমা হয়। ১৯টি চেকের মাধ্যমে জমা হওয়া টাকার মধ্যে ৭৬ লাখ ৪৮হাজার ৪১৫ টাকা তোলেন নির্মাণ কমিটির ১ নম্বর সদস্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম। ওই টাকা ব্যয়ের সঠিক বিল বা ভাউচার তদন্ত কমিটিকে দেখাতে পারেননি অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম। এ ছাড়া সিন্ডিকেট সভায় প্রতি ১০ লাখ টাকা উত্তোলনের পর সেসব বিল বা ভাউচার অর্থ দপ্তরের মাধ্যমে সমন্বয় করে পরবর্তী চাহিদাপত্র দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হলেও অধ্যাপক সুলতান তা করেননি। এমনকি এখনও তদন্ত কমিটির কাছে দাখিল করতে পারেননি বলে জানা যায়।

শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকে এক হাজার ৪০০ কেজি তামা ব্যবহারের কথা ছিল, যার মূল্য ১৪ লাখ টাকা। অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম সাড়ে ৮ লাখ টাকা দিয়ে মাত্র ৮৫০ কেজি তামা কেনেন। এর মধ্যে আবার ২০-২৫ শতাংশ ওয়েস্টেস দেখানো হয়েছে। কাস্টিংয়ের সময় নষ্ট হয়েছে আরও ১২০ কেজি এবং অন্যান্যভাবে নষ্ট হয়েছে ২৬ কেজি। ফলে স্মৃতিফলকটিতে ৪৯২ কেজি তামা ব্যবহার করা গেছে, যার মূল্য চার লাখ ৯২ হাজার টাকা। এ ছাড়াও তিন লাখ ৬০ হাজার টাকার টেম্পার্ড গ্লাস ব্যবহার করার কথা থাকলেও সেটি ব্যবহারের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

তবে তদন্ত কমিটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তার বিরুদ্ধে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে বলে দাবি করেছেন নির্মাণ কমিটির প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম। এ বিষয়ে তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে অসত্য ও বিভ্রান্তকর তথ্য ছড়াচ্ছে। বর্তমান প্রশাসন আমাদের টাকা না দেওয়ায় আমরা সবার পাওনা শোধ করতে পারিনি। সে জন্য সব হিসাব দিতে পারিনি। তা ছাড়া এর কাজ তো ব্যক্তি সুলতান-উল-ইসলাম একা করেননি, এর সঙ্গে কয়েকটি ছোট গ্রুপে কাজ হয়েছে, তাহলে আমি একা কীভাবে এটি করলাম? ১৯টি চেক উত্তোলন করলেও এসব চেক তৎকালীন উপ-উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষরে তোলা হয়েছে। তাছাড়া তামার বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আমরা সিন্ডিকেটে গ্রহণ করেছি। এ ধরনের অপরাধের জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায় বা কীভাবে প্রতিকার করা যায়, সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের লিগ্যাল (আইন) সেলের মতামত চেয়েছি। আশা করি, এ মাসের শেষের দিকে সে মতামত পেয়ে যাব। তাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে সিন্ডিকেট ব্যবস্থা নেবে।