এক বুক ভালোবাসা নিয়ে বিজয় বরণ করে তরুণরা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। ভয়াল কালো রাত। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে বাংলার দামাল ছেলেরা তাদের জীবনকে তুচ্ছ করে দেশকে এনে দেয় স্বাধীনতা। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অবসান ঘটে তেইশ বছরের শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতনের কালো অধ্যায়। এরপর দেখা দেয় চির কাঙ্ক্ষিত সেই বিজয়।
৭১ এর ডিসেম্বরের শুরুতেই এদেশে আকাশে বইতে শুরু করে বিজয়ের সুবাতাস। ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পনের মধ্যদিয়ে সুনিশ্চিত হয় আমাদের বিজয়। আর তাই প্রতিবছর এদিনে আমরা মেতে উঠি বিজয়ের আনন্দে। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে এই আনন্দের ভাগীদার আমরা সবাই।
তবে বিজয়ের এই আনন্দ তখনই সার্বজনীন হয়, যখন ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই এর মাহাত্ম্য অনুধাবনে প্রণোদিত হয়। যেহেতু তরুণরাই দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা। তাই বিজয়ের এই মাহাত্ম্য জানতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন মেধাবী শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন প্রতিবেদক। বিজয় দিবসের নানা ভাবনার কথা জানিয়েছে তরুণরা। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস পাঠকদের উদ্দেশ্যে সেগুলো তুলে ধরা হলো—
আখতার হোসেন আজাদ
শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ
“বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি সংশোধন করে সর্বস্তরে বিজ্ঞানভিত্তিক উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে”
বিজয়ের এই ৪৮ বছরেও আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়ের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে দল, মত নির্বিশেষে ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারিনি। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বদলের অপচিত্র আমাদের তরুণ সমাজকে ব্যথিত করে। আজও আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের স্বার্থে সকলে বাংলাদেশী পরিচয় দিতে পারি না। জাতীয় ঐক্যের চেয়ে দল বা মতের ভিন্নতার দরুণ আমরা পরস্পরকে বিভিন্ন বিরূপ উপাধি দিয়ে নিজের ভেতরে নিজেরাই বিভক্তির সৃষ্টি করে যাচ্ছি। গ্রাম-প্রধান বাংলাদেশে শহরকেন্দ্রিক উন্নয়নে কখনোই জাতিগতভাবে সামষ্টিক উন্নয়ন সম্ভব হবে না। রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষকে গ্রামকে প্রাধান্য দিয়ে উন্নয়ন যজ্ঞ চালাতে হবে। ‘টাকা যার, শিক্ষা তার’ এমন বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতির সংশোধন করে সর্বস্তরে বিজ্ঞানভিত্তিক উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি শিক্ষার সাথে নৈতিকতার সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে। তবেই আমরা দুর্নীতিমুক্ত, শোষণমুক্ত বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।
জি কে সাদিক
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ
“স্বাধীনতার স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে আমাদের সেই হিসাব কষতে হবে”
স্বাধীনতার স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে আমাদের সে হিসাব কষতে হবে। প্রায় অর্ধশতক আগে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির শোষণ, বৈষম্য, নির্যাতন ও শিক্ষা-সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক ও মুক্তিকামী মানুষের জীবনবাজির লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক শোষণ, বৈষম্য ও নির্যাতনমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন ছিল। আর এ প্রত্যয় নিয়েই জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। নানা চড়াই-উতরাই পার করে আজকে স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক পরে আমাদের আবার নতুন করে হিসাব কষতে হচ্ছে। আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়-বিচার কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি? এই তিনটি বিষয়কে বাস্তবায়নের জন্য যে চারটি মৌলিকভিত্তি- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন স্বাধীনতার স্বপ্ন কতটা সফল হয়েছে? প্রত্যেক দেশপ্রেমিক, শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিককে এই প্রশ্ন উত্থাপন করতে হবে এবং এর উত্তর খুঁজে প্রত্যাশা-প্রাপ্তির হিসাব কষে আগামীর লক্ষ্য স্থির করতে হবে। কারণ এই দেশটা আমাদের; এই দেশের মাটির সাথে মুক্তিকামী মানুষের পবিত্র রক্ত লেগে আছে। বিজয়ের মাসে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত এই ভূমিতে তাদের স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে এবং কতটা হয়নি এই হিসাব কষা অবশ্য দায়িত্ব।
জান্নাতুল ফেরদৌস
শিক্ষাথী, ইংরেজি বিভাগ
“তরুণেরা এক বুক ভালোবাসা নিয়ে বিজয় বরণ করে”
“এই স্বাধীনতা তখনই আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলার কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে।” -বঙ্গবন্ধু
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও যখন এই বাংলার কৃষক মজুরের দুঃখের অবসান হয়নি, তখন স্বাধীনতা নিয়ে সত্যিই প্রশ্ন ওঠে। কতটা দুঃখে একজন কৃষক তারই সোনার ফলসে আগুন ধরিয়ে, অসহায় বসে রয়। কোথা থেকে একঝাঁক বিজয় এসে তার পাশে দাঁড়ায়। যখন বাংলাদেশের কচিকচি প্রাণগুলো সড়ক কেড়ে নেয়। তখন লাখো বিজয় বুক চিতিয়ে হুঙ্কার দেয়। বাঙালি সেদিন পরাধীনতা মেনে নেয়নি, আজও না, কোনদিন নিবেও না। হ্যাঁ, হয়ত প্রেক্ষাপটগুলো কালের ছায়ায় ভিন্ন ভিন্ন। আমরা তরুণেরা বিজয় আজও বুকে ধারণ করি। তবে কেন তনুরা একলা চলতে ভয় পায়? আবরার কেন অসীমের পাড়ে চলে যায়? কারণ সেদিনও কিছু বাঙালি বিপথে ছিল, ছিল বিজয়ের বিপরীতে। বিজয় এক লালটকটকে সূর্য, দেশের ছায়ায় কিছু পরগাছা, ছত্রাক সেই সূর্যের গৌরব মাটি করতে চাই। তবু সব বিরুদ্ধগামী পিছনে ফেলে আবার আসে, বারবার আসে বিজয়। তরুণেরা এক বুক ভালোবাসা নিয়ে বিজয় বরণ করে। ছোট্টশিশু যখন পিতার কাধে, গোটা বাংলাদেশ ছোট্ট গালে ধারন করে। বিজয়ের চেতনা হারানোর ভয় মাথা নিচু করে পালায়। ‘যদি তুমি হেরে যাও তবে তুমি শেষ। যদি তুমি জিতে যাও তবে তুমি বাংলাদেশ।’
মু. ইলিয়াস আলমগীর
শিক্ষার্থী, আল-ফিক্হ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ
“বিজয়ের মাসে আকুতি, স্বাধীনতা ছুঁয়ে তৃপ্তির আবেশ নিয়ে যেন নিঃশ্বাস নিতে পারি”
বিজয় ও স্বাধীনতা সবসময়ই জীবনের গভীর অনুভূতিকে সুখ ও শান্তিময় করে তোলে। জাতিসত্ত্বাকে নির্মাণ করে সুশোভিত ছন্দে। তাই বিজয় ও স্বাধীনতা অনুরণিত হয় সৃষ্টিশীল ভাবনায়। কাব্যিক দোতনায় গড়ে ওঠে বাস্তবিক অনুপ্রাস। আমিও চাই আমাদের বিজয়কে অনুভব করতে, ছুঁয়ে ওম নিতে। কিন্তু পারি কোথায়। আমিই আমাকে একজন বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে এই যে সবুজ দেশ, সবুজ মানচিত্রে শিক্ষাকে অনুভব করতে পারি না, চিকিৎসাকে অনুভব করতে পারি না, মৌলিক অধিকারকে অনুভব করতে পারি না, ছুঁতে পারি না। অধরাই রয়ে গেল আমার অনুভূতির বিকাশ। বিজয় ও স্বাধীনতার তৃপ্তি। বিজয়ের মাসে আমার আকুতি, এ স্বাধীনতা ছুঁয়ে তৃপ্তির আবেশ নিয়ে যেন নিঃশ্বাস নিতে পারি এই মানচিত্রের সজীবতায়!