কোটি টাকার সিটবাণিজ্য ছাত্রলীগ নেত্রীদের, প্রশাসন নাচের পুতুল
প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার শিক্ষার্থীর বিদ্যাপীঠ রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ। বিপুল সংখ্যক এ শিক্ষার্থীর বিপরীতে রয়েছে মাত্র ছয়টি ছাত্রীনিবাস। হলগুলোতে সর্বসাকুল্যে সিট আছে ৩৩১০টি। তা সত্ত্বে বসবাস করছেন অন্তত ১২ হাজার শিক্ষার্থী। একেক কক্ষে ১২ থেকে ১৫ জন পর্যন্ত থাকছেন। গাদাগাদি করে অনেকটা কষ্টের মধ্যেই থাকতে হচ্ছে তাদের। এর ফলে পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে ওই শিক্ষার্থীদের। সঙ্কটকে কাজে লাগিয়ে সিটবাণিজ্য করছেন ছাত্রলীগ নেত্রীরা। তারা বছরে অন্তত কোটি টাকার বাণিজ্য করছেন।
কলেজটির ৬টি আবাসিক হলের বেশিরভাগ কক্ষই নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। আসন সংখ্যার বাইরে ও ভিতরে সকল শিক্ষার্থীরা বেশির ভাগ ছাত্রলীগ নেত্রীদের এককালীন ও মাসিক চাঁদা দিয়ে থাকতে হয়। আসন সংখ্যার বাইরে প্রত্যেক শিক্ষার্থী বছরে এককালীন ১৫ হাজার থেকে শুরু করে ২০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয় নেত্রীদের। বৈধ সিট সংখ্যার বাইরে প্রতিজন থেকে ১৫ হাজার টাকা করে নিলেও ৯ হাজার শিক্ষার্থী থেকে বছরে ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা হল বাণিজ্য হয়। এই সংখ্যাটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি বা কমও হতে পারে। এই টাকা বাণিজ্য করতে হলের অনেক কক্ষকে পলিটিক্যাল রুম বানিয়েছেন ছাত্রলীগের নেত্রীরা। শিক্ষার্থীর তুলনায় হলে আসন কম থাকার এ সুযোগ নেন নেত্রীরা।
আবার অনেকে শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পরও অর্থের বিনিময়ে এসব রাজনৈতিক কক্ষে থাকার সুযোগ পান। এমনকি কিছু কিছু আসনে বহিরাগত ছাত্রীদের, কর্মজীবীদের থাকার অভিযোগ রয়েছে। ছাত্রলীগ নেত্রীদের মাধ্যমে হলে ওঠায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যাওয়া তাদের জন্য বাধ্যতামূলক। কেউ না যেতে চাইলে তার ওপর চলে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। কিন্তু হলে থাকতে হলে এসব মেনে নিতে হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নতুন ১১তলা বিশিষ্ট শহীদ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রীনিবাস রাজনৈতিক নেতাকর্মী হল হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। প্রতিবছর বৈধ সিটে ওঠার সুযোগ পান প্রতিটি বিভাগ থেকে ৬-৭ জন। এই হিসেবে করলে বছরে ৮০-৯০ জন বৈধ সিট পান। তবে সিটের তুলনায় প্রার্থী অনেক হওয়ায় সবার ভাগ্যেই এ সুযোগ জুটে না। আর এ সুযোগটিকেই কাজে লাগিয়ে রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন কলেজ ছাত্রলীগের গুটিকয়েক নেত্রী।
অনেক ছাত্রীদের প্রতি মাসে সিট ভাড়া গুণতে হয় ২ হাজার টাকার মতো। কলেজের বাইরের শিক্ষার্থীরা এবং যাদের শিক্ষাজীবন শেষ তাদের মাসিক ভাড়ার বিনিময়ে ছাত্রীনিবাসে থাকার সুযোগ করে দেন ছাত্রলীগ নেত্রীরা। এ নিয়ে গত সপ্তাহে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংষর্ষ বাধে। সেখানে এক নেত্রীর সামনেই তার অনুসারীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপ দেন আরেক নেত্রীর অনুসারী।
ঘটনার সূত্রপাত একজন বহিরাগত শিক্ষার্থীকে হলে রাখাকে কেন্দ্র করে।
কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুবা নাসরিন রূপা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের ২১৯ নং কক্ষে নাবিলা নামের একজন বহিরাগত শিক্ষার্থীকে টাকার বিনিময়ে রাখতেন। তাকে রাখাকে কেন্দ্র করে হলে অন্য নেত্রীদের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়। এ সময় রূপার এক অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মী সাবিকুন্নাহার তামান্নার হাতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপ দেন। ওই ঘটনার একদিন পর কলেজে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্ধে সুস্মিতা নামে আরেক ছাত্রলীগকর্মী হামলার শিকার হন। কলেজ শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক রিভা, বিথি, জারিন পূর্ণি, ইতি, পাপিয়া রায়, পাপিয়া পিয়া, জান্নাত আরা জান্নাত তাকে মারধর করে বলে অভিযোগ উঠেছে।
কলেজের আবাসিক সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সাধারণ কক্ষের চেয়ে কলেজের প্রতিটি হলেই পলিটিক্যাল রুম এর সংখ্যা বাড়ছে। এই পলিটিক্যাল রুমে সিটে ওঠানোর জন্য প্রথম বর্ষের ছাত্রীদের টার্গেট করছেন ছাত্রলীগ নেত্রীরা। হল কর্তৃপক্ষের প্রথম বর্ষের ছাত্রীদের সিট বরাদ্দ দেয় না। ফলে পলিটিক্যাল সিটে ওঠানোর ক্ষেত্রে প্রথম বর্ষের ছাত্রীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকাও নিচ্ছেন তারা। নবীন ওই ছাত্রীদের কাছ থেকে এককালীন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে নেত্রীরা। আবার মাস্টার্স শেষ হয়েছে এমন অনেককেও অবৈধভাবে হলে সিট দিচ্ছেন তারা। এক্ষেত্রে প্রতিমাসে নেয়া হচ্ছে আড়াই থেকে তিনহাজার টাকা।
তবে এ বাণিজ্যে সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন বহুল বিতর্কিত বিবাহিত ছাত্রলীগ নেত্রী আঞ্জুমান আরা অনু। ছাত্রলীগের একেক সময় একেক কেন্দ্রীয় নেতার নাম ভাঙিয়ে দাপিয়ে বেড়ান তিনি। প্রতিটি হলেই রয়েছে ছাত্রলীগ নেত্রীদের বেশ কয়েকটি করে পলিটিক্যাল রুম। সেই কক্ষগুলো নেত্রীদের দখলে। ওই সব রাজনৈতিক কক্ষে ওঠা কিংবা নামা পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করেন প্রতিষ্ঠানটির ছাত্রলীগ নেত্রীরা। আহ্বায়ক কমিটির একটা বড় অংশ এই সিট বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি গণিত বিভাগের ২০০৮-০৯ সেশনের শিক্ষার্থী। ২০১৬ সালে তার ছাত্রত্ব শেষ হয়। বিবাহিত এই নেত্রী কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটিতে পদ পান।
অভিযোগ রয়েছে, তিনি ইডেন কলেজের রাজিয়া বেগম হলের দুইটি কক্ষ নিয়ে থাকেন। এছাড়া খোদেজা খাতুন ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলে তিনি বেশ কয়েকটি কক্ষ নিয়ন্ত্রণ করছেন। তবে আঞ্জুমান আরা অণু বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, আমাদের সম্মেলন হয়ে গেছে পাঁচ ছয়মাস আগে। আমি তো আর এখন আর হলে থাকি না। তাহলে বাণিজ্য করবো কিভাবে। এগুলো মিথ্যা।
সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ইডেন ছাত্রলীগের সম্মেলন। তবে প্রতিষ্ঠানটিতে এখনো কমিটি পেতে জোর লবিং-তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে ভুরি ভুরি অভিযোগ। অভিযোগ রয়েছে,ক্যাম্পাসে যিনি যত বেশি কক্ষের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবেন তিনি ততটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজিয়া হল ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের চারটি তলার মোট ৮২টি কক্ষ কলেজের ছাত্রলীগ নেত্রীরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। এসব কক্ষ সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে পলিটিক্যাল রুম নামে পরিচিত। রাজিয়া হলে ৩৪টি কক্ষ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের ৭২টি কক্ষ, পাঁচতলা এই হলের নিচতলা ও দোতলার ৩০টি কক্ষের সবকটি ছাত্রলীগ নেত্রীদের পুরোপুরি দখলে। প্রতিটি কক্ষে চারটি বিছানায় আটজনের থাকার ব্যবস্থা থাকলেও এসব রাজনৈতিক কক্ষে কমপক্ষে ১৭ থেকে ১৮ জন করে ছাত্রী থাকেন। কোনো কোনো কক্ষে আরও বেশি ছাত্রী থাকছেন। পালাক্রমে বিছানা ও মেঝেতে থাকার রুটিন এক দিন পরপর পরিবর্তন হয়।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের দোতলা ও তিন তলা মিলিয়ে ৭৪ টি রাজনৈতিক কক্ষ। গ্যাসের চুলা ও লিফটের সুবিধা থাকায় নতুন এই হলে ছাত্রীদের ওঠাতে অন্য হলগুলো থেকে বেশি টাকা খরচ করতে হয়। অভিযোগ রয়েছে এই হলে ওঠতে কারো কারো ৩০ হাজার টাকাও দিতে হয়েছে। এই হলের এক শিক্ষার্থী জানান ৩০২,৩০৩,৩০৮,৩০৯, ৩১০,৩২০,৩২১ কক্ষগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন তাসলিমা। আর বাকীগুলো আঞ্জুমান আরা অণু ও অন্য নেত্রীর। যেখানে রুমের সিট খালি হয় জানলেই নতুন কাউকে উঠিয়ে তারা টাকা নেন। এসব রাজনৈতিক কক্ষগুলোর একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগ নেত্রী তাসলিমা আক্তার। কয়েক বছর আগেই তার ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে, তবে এখনো তিনি হল ছাড়েননি। পুরো ক্যাম্পাসে তার নিয়ন্ত্রণাধীন অসংখ্য কক্ষ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে তিনি অর্থের বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের হলে ওঠান।
সিট বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের সাথে দুর্ব্যবহার, জোরপূর্বক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নেয়া বহু অভিযোগে অভিযুক্ত কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক বিপাসা খাতুন। সিট বাণিজ্য, ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার, প্রতিপক্ষের উপর হামলাসহ বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে বিদায়ী কমিটির আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুবা নাসরিন রুপার বিরুদ্ধে। সিট বাণিজ্য, কর্মীদের উপর নির্যাতন, ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তারসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রী মুনমুন নাহার বৈশাখী। তিনি যুবলীগ থেকে সম্প্রতি বহিষ্কৃত এক প্রভাবশালী নেতার বান্ধবী হিসেবে পরিচয় দিতেন। ওই পরিচয় ব্যবহার করে তিনি নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। সেই যুবলীগ নেতা আটকের পর তিনি লোক চক্ষুর আড়ালে রয়েছেন।
সিট বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগ নেত্রী নাসিমা আক্তার এবং ইফরাত জাহান ইতির বিরুদ্ধে। রাজিয়া হলের ইংরেজী বিভাগের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না শর্তে বলেন, বেশীর ভাগ শিক্ষার্থীই কোনো না কোনো ভাবে প্রথমে পলিটিক্যাল রুমে থাকতে হয়েছে। কারণ বৈধ সিটের পরিমাণ খুবই কম। আয়েশা সিদ্দিকা হলের অর্থনীতি বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী বলেন ‘আমাদের হলে প্রায় এক হাজার সিটের বিপরীতে তিন থেকে চার হাজার ছাত্রী রয়েছে। প্রতিটি ফ্লোরেই সাত-আটটির রুমের মধ্যে কমপক্ষে পাচঁটি রুম পলিটিক্যাল। এসব রুমে চারটি করে বেড থাকলেও ১৮ জনও থাকছে। যা খুব কষ্টকর। কিন্তু কিছুই করার নেই। এভাবেই আমাদের থাকতে হয়। একরুমে এতজন থাকলে বুঝেন কেমন কষ্ট করতে হয়। জেবুন্নেছা হলের শিক্ষর্থী বলেন ‘আমরা যখন হলে উঠেছি তখন বৈধভাবেই বেশি উঠত। কিন্তু এখন পলিটিক্যাল রুম বেশি। কলেজ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কম সিট দেন। ফলে এসব ছাত্রী নেত্রীদের ধরে অবৈধভাবে সিট নিচ্ছে। এজন্য নেত্রীদের এককালীন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা দিচ্ছে তারা। পরবর্তী সময়ে বৈধ হওয়ার পর হল র্কর্তৃপক্ষকে আবার প্রতি দুই বছরের জন্য ৯ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে এ বিষয়ে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক তাসলিমা আক্তার বলেন, আমি ছাত্রলীগ থেকে গত ২৪ জুন অবসর নিয়েছি। এর আগের সকল কিছুর দায়ভার আমি নিবো। এই বাণিজ্য দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে কেনো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই ধরনের কোনো অভিযোগ আমার কাছে নেই। শুধু তাই নয় এর বাইরেও যদি অন্য কোনো অভিযোগ আমার কাছে আসতো তখন আমি সাথে সাথে ব্যবস্থা নিতাম। সিট বাণিজ্যে অভিযোগটি ইডেনের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই হয়ে আসছে এটা নতুন কিছু না।
এ বিষয়ে ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ শামসুন নাহার বলেন, এই মুহূর্তে এসব বিষয় নিয়ে কোনো অভিযোগ আমার কাছে নেই। কোনো ধরনের সমস্যাও হচ্ছে না।