স্ট্যাটাস তো দূরের কথা, লাইক-কমেন্টেও ভয় পাই
দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থাকা শিক্ষার্থীদের ফেসবুকের লাইক, কমেন্ট নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রলীগ। শুধু ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য হলগুলোতে ছাত্রলীগের আলাদা টিম রয়েছে। মূলত প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা কে কোন আদর্শে বিশ্বাসী তা যাচাই করার জন্য এটি করা হয় বলে দাবি করছেন নেতাকর্মীরা। তবে সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বলছেন, এসব করার এখতিয়ার ছাত্রলীগের নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুয়েট, ঢাবি, জাহাঙ্গীর নগর, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ আবাসিক হল আছে এমন বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই ফেসবুকের পোস্টকে কেন্দ্র করে কমবেশি শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। চড়-থাপ্পড় থেকে শুরু করে লাঠি দিয়ে পেটানোর ঘটনাও ঘটেছে অহরহ। বড় ভাইদের চড় খেয়ে অনেকের কানের পর্দা ফেটে গেছে। সর্বশেষ গত সোমবার রাতে ফেসবুকের পোস্টকে কেন্দ্র করে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরারকে নির্মমভাবে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
এ নিয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে কেউ নাম পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি। নির্যাতিতরাও ভয়ে মুখ খুলছেন না। এমনকি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত নিজেদের নাম পরিচয় বলেননি। নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে দ্বিতীয় বর্ষের একজন ছাত্র বলেন, 'চলমান পরিস্থিতি হয়তো কয়েকদিনেই শান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু এখানে আমাদের সবসময় থাকতে হবে। শুধু হলে নয়, প্রতিটি ফ্লোরেই ছাত্রলীগের টর্চার সেল আছে। যারা হলে থাকেন তাদের কেউ নিজেদের ইচ্ছামতো কোনো পোস্টে লাইকও দিতে পারেন না বলে জানান তিনি।'
ড. রশিদ হলের একজন শিক্ষার্থী বলেন, সরকার বা ছাত্রলীগের সমালোচনা করে স্ট্যাটাস দেয়া বা শেয়ার করা তো দূরের কথা এমন কোনো পোস্টে লাইক দিলেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ কারণে অনেকেই ফেক বা ভিন্ন নামে আইডি ব্যবহার করেন। যারা হলে থাকেন তারা নিজেদের ইচ্ছামতো ফেসবুক ব্যবহার করতে পারেন না।
শেরে বাংলা হলের অপর একজন শিক্ষার্থী জানান, আবরারকে মারধর করার সপ্তাহ খানেক আগে শেরেবাংলা হলের দুই শিক্ষার্থীকে ডেকে নিয়ে ফেসবুকের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন ছাত্রলীগ নেতারা। এ সময় তাদের চড়-থাপ্পড়ও মারা হয়। সবাই ক্ষুব্ধ হলেও ভয়ে এসব বিষয়ে মুখ খোলেন না কেউ।
এদিকে, ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীদেরও একই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় বলে জানা গেছে। তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল না থাকার কারণে এই সমস্যা নেই। মেয়েদের হলগুলোতেও তেমন একটা সমস্যা হয় না বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবসিক হলে থাকে এমন ১০/১২ জন ছাত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি হলের শিক্ষার্থীদের ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্ট, লাইক, কমেন্টে নেতাদের নজর থাকে। সরকারবিরোধী কোনো পোস্টে লাইক দিলেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রায় প্রতি রাতেই হলের গেস্টরুমে এমন ঘটনার বিচার হয়। এজন্য ছাত্রলীগের বেশ কয়েকটি টিম রয়েছে। যারা ছাত্রদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে। কারো পোস্ট বা লাইক, কমেন্ট সন্দেহ হলে তারা স্ক্রিনশট দিয়ে বড় ভাইদের কাছে দেয়। বড়ভাইরা অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সঠিক উত্তর দিতে না পারলে চড়-থাপ্পড় খেতে হয়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি (ভিপি) নুরুল হক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে ফেসবুকের পোস্টের কারণে ছাত্রদের নির্যাতন করা হয়। কিছুদিন আগে তার পোস্টে কমেন্ট করার কারণে এক ছাত্রকে মারধর করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক এক নেতা (হলে থাকেন) বলেন, ছাত্রলীগ ফেসবুকের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে না। মূলত সে কোন আদর্শে বিশ্বাসী, জামায়াত-শিবির করে কি না বা দেশবিরোধী কোনো কর্মকান্ডে জড়িত কি না, কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে কি না- তা দেখার জন্য ফেসবুক ও মোবাইল চেক করা হয়। কেউ বিতর্কিত কোনো পোস্টে লাইক কমেন্ট দিলে তার সাথে কথা বলা হয়। তার সঙ্গে কার কার যোগাযোগ আছে তা দেখার জন্য কল লিস্ট, ম্যাসেঞ্জার, ইমো, ভাইবার চেক করা হয়। তা ছাড়া কার টেবিলে কোন বই, মোবাইলে কে কী শোনে তাও যাচাই করেন নেতারা।
অন্য একজন শিক্ষার্থী জানান, চলতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেসবুকের কারণে বড় ভাইদের থাপ্পড় খেয়ে অন্তত তিন ছাত্রের কানের পর্দা ফেটে গেছে। ভয়ে ছোটখাটো নির্যাতনের ঘটনা অনেকেই প্রকাশ করেন না।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ফেসবুক নিয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি ফেসবুকের পোস্টকে কেন্দ্র করে তিন ছাত্রীকে হুমকি দেয় ছাত্রলীগ। তা ছাড়া ছেলেদের হলগুলোতে অহরহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্ররাও এমন নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছেন বলে জানা গেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলগুলোতে এই সমস্যা খুব কম। শুধু পলিটিক্যাল রুমে যারা থাকেন, তাদের কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কোনো পোস্ট শেয়ার করলে বা লাইক কমেন্ট করলে, তা জিজ্ঞাসাবাদের এখতিয়ার ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মীর নেই। ছাত্রলীগ এমন কাজ সমর্থন করে না। কে কি পোস্ট দিল বা কমেন্ট করল তা দেখভাল করার দায়িত্বও দেয়া হয়নি ছাত্রলীগের কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীকে। এরপরও অতি উৎসাহী হয়ে কেউ এমন কাজ করে থাকলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।