ঐতিহ্যের সংগীত কলেজে শুধু বেদনার সুর
দেশ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ও পণ্ডিত বারীণ মজুমদারের স্বপ্নে গড়ে ওঠা, কণ্ঠশিল্পী আবদুল আলীমের প্রিয় প্রতিষ্ঠান সরকারি সংগীত কলেজে গত ৩৪ বছর ধরে বিরাজ করছে বেদনার সুর। গৌরব ও ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠানটি বর্তমেনে উন্নয়ন বঞ্চনা আর শিক্ষকসহ নানা সংকটে জর্জরিত। এসব সংকট দূর করা সম্ভব হলে কলেজটি সগর্বে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
লোকসংগীতপ্রিয় মানুষকে বাংলাদেশে আবদুল আলীমের সেই গানের কথা মনে করিয়ে দেয়, ‘ও যার আপন খবর আপনার হয় না’। প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষও তার নিজের খবরই যেন রাখে না। আর তাই বিরহ ‘বেহাগ’ যেনও থামছেই না দেশের একমাত্র সরকারি সংগীত কলেজে।
সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁওয়ের অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী এই সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে ঘুরে যে বেহাল দশা চোখে পড়ে তাতে বেদনা ছাড়া আর কোনো বীণার সুর বাজানো সম্ভব নয়।
সরেজমিন জানা যায়, ‘তুমি আরেকবার আসিয়া, যাও মোরে কান্দাইয়া’ গানের শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েছেন রাজধানীর সরকারি সংগীত শিক্ষা কলেজে। ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’ গানের শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহর প্রাতিষ্ঠানিক সংগীত চর্চাও এই প্রতিষ্ঠানে। গুণী এসব মানুষের প্রিয় প্রতিষ্ঠান সরকারি সংগীত কলেজের বাইরের পরিবেশ দেখলে রথীন্দ্রনাথের গানের মতো ‘মনের সুখে’ নয় মনের দুঃখেই কান্না আসতে পারে। আর চারপাশ ও সড়কের বেহাল অবস্থা দেখে শাহনাজ রহমতুল্লাহর গ্রামের সুন্দর চিত্রের বিপরীতে মিলবে শহুরে রাস্তায় বর্ষার নোংরা কাদা-মাটি-জল। এ তো শুধু বাইরের চিত্র, ৫৫ বছরের পুরনো এই প্রতিষ্ঠানের ভেতরেও জমে আছে নানা সংকট। উন্নয়ন বঞ্চনার ৩৪ বছরের অশ্রু জমে আছে প্রতিষ্ঠানটিতে।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কণ্ঠশিল্পী আবদুল আলীমের মেয়ে নূরজাহান আলীম বলেন, ‘সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই পরিবেশ এবং উন্নয়ন বঞ্চনা আমাদের কষ্ট দেয়। এই প্রতিষ্ঠানে আমার বাবা লোকসংগীত বিভাগের প্রধান ছিলেন। পণ্ডিত বারীণ মজুমদারের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কাজ করেছেন আমার বাবা। রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের একমাত্র সরকারি সংগীত কলেজটিকে গুরুত্ব দিলে এই প্রতিষ্ঠানটি হতে পারে দেশসেরা। যথাযথ কর্তৃপক্ষ নজর দিলেই প্রতিষ্ঠানটির জন্য সাংস্কৃতিক ভবন ও আধুনিক স্টুডিওসহ একটি আর্কাইভ নির্মাণও খুবই দরকার। সংগীত শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ যেমনটি হওয়া দরকার, তেমনটি যেনও দ্রুত হয়—সে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত কর্তৃপক্ষের।’
দেখা গেছে, কলেজের গেটটি ছাড়া সামনের দুই পাশের ফাঁকা জায়গায় ডাম্পিং স্টেশন বাউন্ডারি দেয়াল ঘেঁষে। গেটের পাশেই ভাঙাচোরা গাড়ি আর ময়লার স্তূপ জমে আছে। মূল ফটকের খুব কাছে না গেলে কোনোভাবে বোঝার উপায় নেই, দেশের ঐতিহ্যবাহী একমাত্র সরকারি সংগীত কলেজটি এখানে রয়েছে।
কলেজের ভেতরে গিয়ে জানা যায়, ১৯৬৩ সালে পণ্ডিত বারীণ মজুমদার কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশবরেণ্য শিল্পীরা শিক্ষকতা করেছেন এই প্রতিষ্ঠানে। দেশখ্যাত কণ্ঠশিল্পীরা সংগীত শিক্ষা নিয়েছেন এখানে। প্রতিষ্ঠানটি নানা চড়াই উৎরাইয়ের পর ১৯৮৪ সালে সরকারি করা হয়। সরকারি হওয়ার পর ৩৪ বছর ধরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি উন্নয়ন বঞ্চিত। দেশের একমাত্র সরকারি কলেজ হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানে যা যা থাকা দরকার বস্তুত তার কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানের একমাত্র চারতলা ভবনটি সাদামাটাভাবেই নির্মিত, যা সংগীত শিক্ষার উপযুক্ত নয়। সরকারি হওয়ার অনেক বছর পার হলেও একটি অডিটরিয়াম নির্মাণ হয়নি। শুধুমাত্র অডিও রেকর্ডিংয়ের জন্য একটি পুরনো স্টুডিও থাকলেও তা আধুনিক যুগে অকার্যকর।
অ্যাকাডেমিক বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একাদশ থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত মোট সাড়ে চারশ’ শিক্ষার্থীর বিপরীতে অধ্যক্ষ, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও অতিথি শিক্ষকসহ মোট শিক্ষক রয়েছেন ২৯ জন। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি সংগীত বিষয়টি আবশ্যিক। আর স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পড়ানোর জন্য বিষয় রয়েছে রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত, উচ্চাঙ্গ সংগীত, লোকসংগীত এবং তালযন্ত্র বা তবলা। সাড়ে চারশ’ শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র কয়েকজন শিক্ষক।
প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তথ্য মতে, প্রতিষ্ঠানটির অনার্স ও মাস্টার্স পড়ানোর জন্য সংগীতের ইতিহাস বিষয়ের শিক্ষক তিন জন, রবীন্দ্র সংগীতের শিক্ষক দুই জন, নজরুল সংগীতের শিক্ষক দুই জন, উচ্চাঙ্গ সংগীত বিষয়ের শিক্ষক দুই জন, লোকসংগীত বিষয়ের শিক্ষক দুই জন এবং যন্ত্রসংগীত বা তালযন্ত্র বা তবলার শিক্ষক দুজনসহ মোট ১১ জন। আর নজরুল সংগীত, উচ্চাঙ্গ সংগীত ও যন্ত্রসংগীতের জন্য একজন করে অতিথি শিক্ষক রয়েছেন। এছাড়া, পাঁচ জন প্রদর্শক, একজন সহকারী গ্রন্থাগারিক এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। যদিও এনাম কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, এই প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী শিক্ষক থাকার কথা ৯২ জন।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটিতে অনুন্নত একটি ক্যান্টিন থাকলেও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা-আড্ডার জন্য প্রস্তুত করা কোনও জায়গা নেই। চার তলা ভবনটি সাংস্কৃতিক ভবন না হওয়ায় ক্লাসরুমে সাউন্ড ইকো হয়। দেশের আর পাঁচটা সাধারণ সরকারি ভবনের চেয়েও অনুন্নত। প্রতিষ্ঠানের বাইরে কিংবা ভেতরে আঙিনায় কোনও সাইন সিম্বল নেই—যা দেখে বোঝা যাবে এটি একটি সংগীত কলেজ। মাঠের পাশে ক্যাম্পাস থিয়েটার আড্ডার জায়গাটিতে বৃষ্টি হলে আর বসা যায় না। বর্ষায় আড্ডা দেওয়ার মতো আর কোনও ব্যবস্থা নেই সংগীত শিক্ষার্থীদের।
প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তথ্য মতে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠশিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় ও শাহনাজ রহমতুল্লাহ ছাড়াও এই কলেজে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংগীত শিক্ষা নিয়েছেন—খুরশীদ আলম, আবিদা সুলতানা, বিপুল ভট্টাচার্য, মুজিব পরদেশীর মতো খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পীসহ দেশের অনেক গুণী শিল্পী। আর এই প্রতিষ্ঠানে যারা সংগীত শিক্ষা দিয়েছেন, তাদের খ্যাতিও দেশজোড়া। পণ্ডিত বারীণ মজুমদার ও আব্দুল আলীম ছাড়াও শিক্ষাবিদ কাজী মোতাহার হোসেন, কণ্ঠশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সাদী মোহাম্মদ তকিউল্লাহ এবং ইন্দ্রমোহন রাজবংশীসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিও এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন।
কিন্তু দেশের এসব পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও গুণী শিল্পীর পদচারণা যেখানে ছিল, সেই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের এমন অবস্থা কেন? এই প্রশ্ন শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ অনেকের। দেশের একমাত্র সরকারি সংগীত কলেজ হওয়া সত্ত্বেও দেশসেরা প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়নি শুধু কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেই।
সরকারি সংগীত কলেজের প্রধান ফটকের সামনে ডাম্পিং স্টেশনকলেজের লোকসংগীত বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এসএম আশিকুর রহমান বলেন, ‘ছাত্রদের থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই। একটি হোস্টেলে কোনও রকমে ছাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা করা গেলেও ছাত্রদের সে ব্যবস্থা আজও সম্ভব হয়নি। দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীদের পরিবহনের জন্য বাস থাকলেও দেশের একমাত্র সরকারি সংগীত কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য তার ব্যবস্থা নেই। ভালো স্টুডিও না থাকার কারণে রেকর্ডিংসহ প্র্যাকটিস করতে শিক্ষকদের বাসায় যেতে হয়।’
কলেজের লোকসংগীত বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী প্রিয়াংকা হালদার বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানে সংগীত নিয়ে লেখাপড়া করতে পেরে আমি আনন্দিত। ’
প্রতিষ্ঠানটির সঙ্কটের চিত্র তুলে ধরে অধ্যক্ষ কৃষ্টি হেফাজ বলেন, ‘শিক্ষক সংকট দীর্ঘ দিনের। দুই বছর আগে এলে হয়তো এই প্রতিষ্ঠানে ঢুকতেই চাইতেন না বা পারতেন না। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি যথেষ্ট ভালোভাবেই চলছে। গত দুই বছরে শিক্ষার্থী হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করা গেলেই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি আরো সুনাম কুড়াতে পারবে।
অধ্যক্ষ আরো বলেন, ‘একটি সাংস্কৃতিক ভবন নেই। ১২ তলা সাংস্কৃতিক ভবন নির্মাণের জন্য দুই বছর আগে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের সমন্বয়হীনতার কারণে প্রস্তাবটি ঝুলে আছে।’
কিন্তু কবে নাগাদ ভবনের প্রস্তাবটি আলোর মুখ দেখবে সে বিষয়েও কোনো ধারনা দিতে পারেননি অধ্যক্ষ।
শিক্ষক সংকটের বিষয়টি উল্লেখ করে অধ্যক্ষ বলেন, ‘পাঁচজন প্রদর্শকসহ ৩৪ জন স্টাফ। অথচ এনাম কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিতে শুধু শিক্ষক প্রয়োজন ৯২ জন। যা আজো বাস্তবায়ন করা হয়নি।’