গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে থামাবেন কে?
গত দুই দিন ধরে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দুনীর্তি নিয়ে যেসব নথি আমার হাতে এসেছে, তা দেখে সত্যি আমি আঁতকে উঠেছি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে কিভাবে ধীরে ধীরে টর্চার সেল হয়ে উঠে, তা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকলাপ না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে এক ধরনের জিম্মি করে রেখেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিন।
গত এক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি খাত থেকে তিনি ৩৬৫ জনকে প্রায় ৭২ লাখ টাকা দিয়েছেন, মূলত ভিসিপন্থি তৈরি করার জন্য। এই টাকা নেয়ার তালিকায় যেমন কিছু সাধারণ শিক্ষার্থী রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক দলের নেতারা। যারা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে উপাচার্যের হয়ে বিভিন্ন সময় কাজ করে যাচ্ছে। নিজের ক্ষমতা কুক্ষাগত করতে এমন নজির বাংলাদেশের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে কিনা তা আমার জানা নেই।
আঁতকে উঠার খবর হলো, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয়েক বছরে যারা উপাচার্যের বিপক্ষে কথা বলেছেন, তাদেরকে বিভিন্নভাবে হেনেস্তা করা হয়েছে। শারিরিক, মানসিকভাবে হয়রানীর শিকার হয়েছেন অনেকেই। নারী কেলেঙ্কারি, ভর্তি বাণিজ্য, বিউটি পার্লার দিয়ে ব্যবসার মত খবর গত কয়েক বছর গণমাধ্যমের শিরোনাম হওয়ার পরও তিনি রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
তার আক্রোশের সর্বশেষ শিকার হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির এক নারী সাংবাদিক। আমার সাংবাদিকতা জীবনে এমন সাহসী নারী খুব কমই দেখেছি। মেয়েটিকে কয়েকদিন আগে বহিষ্কার করা হয়েছে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস এবং ‘উপাচার্যের ফেইসবুক’ হ্যাক করার হুমকির মত তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে সাময়িক বহিষ্কারের পর একের পর এক ঘটনার জন্ম দিয়ে চলছেন।
গত ১০ অগাস্ট দুপুর ২টা ৫১ মিনিটে একটি স্টাটাসে জিনিয়া লিখেছিল ‘ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ কী হওয়া উচিত? এই স্ট্যাটাস দেয়ার ঠিক এক মাস পর গত ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক নোটিশে মেয়েটিকে সাময়িক বহিষ্কারের কথা বলেন। কিন্তু এই সাময়িক সময়টুকু কতদিন তা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এখন পর্যন্ত পরিষ্কার করেনি।
এরপর বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে সমালোচনা হলে, দুইদিন আগে এই উপাচার্য ক্যাম্পাসের কর্মরত সাংবাদিকদের ডাকে। সেখানে সবার মোবাইল ফোন জমা নেয়া হয়, যাতে করে করে কেউ কোন প্রমাণ না রাখতে পারে কয়েকজন সাংবাদিকদের দাবি।
ঘটনা এখানে শেষ নয়, উপাচার্যের নির্দেশে মেয়েটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতি থেকেও বহিষ্কার করানো হয়। এরপর মেয়েটিকে যারা সমর্থন জানিয়ে এসেছে তাদের মধ্যে এক ক্যাম্পাস সাংবাদিককে আজ মারধর করা হয়েছে।
এমনভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে, যে উপাচার্যের কথার বাহিরে যারা যাবেন তাদের পরিণতি হবে ভয়াভয়। এটা যেন জীবন্ত মিনি ক্যান্টমেন্ট।
উপাচার্যের এমন কারণ কী? বিষয়টি ঘাটতি গিয়ে দেখলাম, ভুক্তভোগি সাংবাদিক এমন কিছু গোপন নথি পেয়েছিল, তা দিয়ে যদি সংবাদ পরিবেশন করা যেত তাহলে, আজ উপাচার্যের চেয়ারের থাকার সময়টুকু পেতেন না।
গত ২৩ অগাস্ট এই নারী সাংবাদিক একটি সংবাদ করেছিল, যার শিরোনাম ছিল ‘বশেমুরবিপ্রবিতে অদৃশ্য কমনরুম ফি বছরে ১২ লাখ টাকা’। যেখানে বলা হয়েছিল, বশেমুরবিপ্রবি) কোনো কেন্দ্রীয় কমনরুম না থাকলেও কমনরুম ফি হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বছরে প্রায় ১২ লাখ টাকা নেয়া হচ্ছে।
এর আগে গত ৩১ শে জুলাই সংবাদ করেছিল, তার শিরোনাম ছিল, ‘গ্যারেজে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন বশেমুরবিপ্রবি ছাত্রীরা’। যেখানে ছাত্রীদের আবাসন সমস্যার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভবন নির্মাণে গড়িমসির করার কথা বলা হয়েছিল। সংবাদের ভাষ্য অনুযায়ী চার বছরেও নির্মানকাজ সম্পন্ন হয়নি শেখ রাসেল হল এবং শেখ রেহানা হলের। টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী হল দুটির নির্মানকাজ ২০১৭ এর জুনের মধ্যে শেষ করার কথা ছিলো।
আর এইসব নিউজ করার পর চক্ষুশূল হতে হয় জিনিয়াকে। কম বয়সে মেয়েটি যে সাহসিকতা দেখিয়েছি তা অন্য কোন সাংবাদিক হয়তো দেখাতে কিছুটা হলেও ভয় পেত। কিন্তু এই সংবাদগুলো পরিবেশনের পর তাকে বিভিন্নভাবে চাপ দেয়া হয়। তাকে বাধ্য করা হচ্ছিল ফরমায়েশি সংবাদ করার জন্য।
সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের স্তুপ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এখন মূর্তিমান আতংক। তা ঢাকতেই সাংবাদিকদের কণ্ঠ চেপে ধরে তিনি নিজেকে সেভ করতে চলেছেন। ক্যাম্পাসে তার অনুসারীদের দিয়ে নিজের জন্য মানববন্ধন করাচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা দিয়ে হাতে রাখা ছেলেদের ব্যবহার করে হুমকি ধামকি এমনকি ফেইসবুকে উপাচার্যের হয়ে গুণকীর্তনমূলক স্ট্যাটাস দিয়ে তিনি প্রচারণা করাচ্ছেন।
যে অভিযোগে মেয়েটিকে বহিষ্কার করেছে, তা এক প্রকার ছুতো। এটাকে কখনোই সমর্থন করা যায় না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনভাবে মত দেয়ার অধিকার প্রত্যক শিক্ষার্থীর থাকা উচিত। তাকে দমন করা এক ধরনের অন্যায়।
এমন উপাচার্য ঠিক কতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে তা আমার জানা নেই। উনাকে ঠিক উপাচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে মানায় কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
মেয়েটির পাশে আমাদের সবার দাঁড়ানো উচিত। উপাচার্যের এমন লাগামহীনতা কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী, এইটা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বুঝতে পারতো তাহলে, মেয়েটিকে তিনদিনের বাচ্ছুর বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ জানার জন্য তার বাপের কাছ থেকে শুনতে বলেছেন, তবে উপাচার্যের কাজ কী, তা জানার জন্য আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’ ভাল করে পাঠ করা উচিত।
আসুন, এই নারী সাংবাদিককে উপাচার্যের নগ্ন থাবা থেকে উদ্ধার করি। তার অনিয়ম ও দুনীর্তির বিরুদ্ধে গণমাধ্যম সোচ্চার হোক। এই উপাচার্যকে রুখতে সরকার তৎপর হবেন বলে আশা রাখছি।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান
ইমেইল: nadim.ru@gmail.com