নিয়মের মারপ্যাচে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারেও আগ্রহ নেই চবি শিক্ষার্থীদের
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে বই নিয়ে প্রবেশ করতে হলে নিজের নাম, বইয়ের নাম ও লেখকের নাম এবং নিজের আইডি নম্বর এন্ট্রি করতে হবে। তারপর আইডি কার্ড জমা রেখে বই নিয়ে প্রবেশ করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের জটিল সব নিয়মের একটি উদাহরণ এটি।
সৌন্দর্য কিংবা সমৃদ্ধিতে কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। প্রায় চার লাখ বই আর ৪০ হাজার প্রিন্ট জার্নাল এবং ৩৫ হাজার ই-জার্নালের অনন্য সমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগার। তবে সেই তুলনায় গ্রন্থাগারে পাঠক সীমিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গ্রন্থাগার বিমুখতার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা মিললো, কিছু উদ্ভট নিয়মের। যেসব নিয়মের ফলে প্রতিনিয়ত গ্রন্থাগারের প্রতি অনিহা বাড়ছে শিক্ষার্থীদের। আর তাই নিয়মের মারপ্যাচে চবির এই সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের বেশিরভাগ আসনই ফাঁকা পড়ে থাকে।
সরেজমিনে চবির ৩৫০ আসনের গ্রন্থাগার ঘুরে দেখা যায়, সর্বমোট ৮২ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছিলেন। এছাড়া বাকী আসনগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। এমন দৃশ্য নতুন নয়। গত এক মাসের গড় উপস্থিতির হিসেবেও দেখা মিলিছে একই দৃশ্য।
গ্রন্থাগারে প্রবেশের এন্ট্রিবুকের তথ্য অনুযায়ী, দিনে সবমিলিয়ে ২৮৯ জন শিক্ষার্থী গ্রন্থাগারে আসা যাওয়া করেছেন। এরমধ্যে সকালের শিফটে গড়ে ২২৮ জনের উপস্থিতি থাকলেও বিকেলের শিফটে মাত্র গড়ে ৬১ জন শিক্ষার্থী লাইব্রেরীতে গিয়েছেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ হাজার শিক্ষার্থীর তুলনায় এই উপস্থিতি বেশ অপ্রতুল।
গ্রন্থাগারের যত নিয়ম: প্রথমেই গ্রন্থাগারে ব্যাগ নিয়ে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এমনকি দীর্ঘদিন এই গ্রন্থাগারে কোনো ধরনের বই নিয়েও প্রবেশের অনুমতি ছিলো না। তবে সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের একাধিক আবেদনের প্রেক্ষিতে বই নিয়ে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করে কর্তৃপক্ষ। যদিও বেশকিছু নিয়ম জুড়ে দেওয়া হয়েছে এখানেও।
কাউকে গ্রন্থাগারে বই নিয়ে প্রবেশ করতে হলে নিচ তলায় বঙ্গবন্ধু কর্ণারে নিজের নাম, বইয়ের নাম, লেখকের নাম এবং আইডি কার্ড ও ব্যাগ জমা রেখে যেতে হবে। তার মানে আইডি কার্ড জমা দেওয়াতে গ্রন্থাগারে থাকা আর কোনো বই পড়ার সুযোগ থাকছে না বই নিয়ে প্রবেশ করা শিক্ষার্থীদের। এক্ষেত্রে শুধু নিজের বইটাই পড়তে হবে।
এজন্য দীর্ঘদিন ধরে গ্রন্থাগারে বই নিয়ে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা কাটলেও বই নিয়ে প্রবেশের অনুমতির সঙ্গে জুড়িয়ে দেওয়া নিয়মটা শিক্ষার্থীদের জন্য যতটা আশির্বাদ তারচেয়ে বড় অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।
গ্রন্থাগারের অন্য নিয়মগুলোর মধ্যে রয়েছে, শিক্ষার্থী যেই বইটা পড়তে চায় সেটার নাম আগে থেকেই জানা থাকতে হবে। কারণ গ্রন্থাগারের দায়িত্বে থাকা স্টাফদের নিকট বইয়ের নাম বললে তারপর তারা কম্পিউটারে সার্চ করে সেই বইয়ের নির্দিষ্ট কোড বলে দেন। সেই কোডটা খাতায় লিখে কিংবা ছবি তুলে গ্রন্থাগারে থাকা অপর এক স্টাফকে দেখালে তিনি আইডি কার্ড জমা রেখে বইটা দেন। তাই শিক্ষার্থীদের বই দেখে নেয়ার সুযোগ নেই এখানে।
এই নিয়মের ফলে শিক্ষার্থীরা যেসকল বইয়ের নাম জানেনা, সেগুলো বছরের পর বছর গ্রন্থাগারে কেবল সাজানোই থাকে। আর তাই সমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারে থাকা হাজারো বই শিক্ষার্থীদের অগোচরেই রয়ে যায়।
চবির লোকপ্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘গ্রন্থাগারে পড়ার পর্যাপ্ত পরিবেশ রয়েছে। কিন্তু কিছু উদ্ভট নিয়মও রয়েছে এখানে।’ উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি গ্রন্থাগার থেকে একটা বই বাসায় নিয়ে নাই পড়তে পারি, তাহলে গ্রন্থাগারে থাকা বই আমাদের ঠিক কতটুকু উপকারে আসবে? যেহেতু গ্রন্থাগারে কেউ সারাদিন বসে থাকবে না। তাই গ্রন্থাগার থেকে বই বাসায় নিয়ে পড়ার সুযোগটা থাকা উচিৎ। প্রয়োজনে আইডি কার্ড জমা রেখে বই নিবে শিক্ষার্থীরা। অথবা অন্য যেকোনো নিয়ম করা যেতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘গ্রন্থাগারে বই নিয়ে প্রবেশের যে নিয়ম করেছে কর্তৃপক্ষ, সেটা শিক্ষার্থীদের জন্য আরও বিব্রতকর। এরচেয়ে আমরা নিজের রুমেই পড়তে পারি। তাই যতদিন এসব নিয়ম পরিবর্তন হবে না, ততদিন এই গ্রন্থাগার শিক্ষার্থীদের কোনো কাজে আসবে না। দেশের অন্যতম বৃহত্তম গ্রন্থাগার হওয়া সত্ত্বেও নতুন বইয়ের সংগ্রহ একেবারেই কম। আর যেখানে বই নিজ হাতে দেখে নেওয়ার সুযোগ নেই সেখানে ছাত্রছাত্রীদের যাওয়ার আগ্রহ না থাকাটাই স্বাভাবিক।’
অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তাসলিমা পপি প্রথম বর্ষে ভর্তির পর থেকেই ক্যাম্পাসে থাকেন। অথচ চার বছরের মধ্যে প্রথম বর্ষের পরীক্ষার আগে কয়েকদিন গ্রন্থাগারে যাওয়া হয়েছে। এরপর লাইব্রেরিতে আর তেমন যাওয়া হয়নি।
এর কারন হিসেবে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমরা পরীক্ষাকেন্দ্রিক পড়াশোনায় গতানুগতিক নোট শীট পড়েই পরীক্ষার দেয়াল টপকাতে পারি। শিক্ষকদের পক্ষ থেকেও বইকেন্দ্রীক পড়াশোনা কিংবা গবেষণার প্রতি কোনো উৎসাহ নেই। এছাড়া গ্রন্থাগারেও অপ্রয়োজনীয় কিছু নিয়মের কারণে গ্রন্থাগারে যাওয়াটাই অনেক ঝামেলা মনে হয়। তাই অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে গ্রন্থাগার কেন্দ্রিক পড়াশোনার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে না।’
এর কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, ‘শিক্ষার্থীদের বই দেখে নেয়ার সুযোগ না থাকা এবং একাডেমিক বই ছাড়া অন্য বই সম্পর্কে ধারণা না থাকা। ফলে শিক্ষার্থীরা গ্রন্থাগারে আসার প্রয়োজনীয়তা মনে করে না। আর যেসকল বইয়ের সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা আগে থেকেই জানে, সেগুলো ইন্টারনেট থেকেই পড়ে নিচ্ছে।’
তবে গ্রন্থাগারে আসা যাওয়ার পরিমাণটা সবচেয়ে কম শহরে থাকা শিক্ষার্থীদের। কথা বলছিলাম চবির ইংরেজী বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নূর হোসেন বিপ্লবের সঙ্গে। তিনি চার বছরে পাঁচ থেকে ছয় বার গ্রন্থাগারে গিয়েছেন।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমি শুরু থেকেই শহরে থাকি। তাই শাটল ট্রেনের শিডিউল মেনে চলতে হয়। আমার মত অনেকেই ট্রেনের শিডিউল মিস করতে চায় না। তাই শহরে থাকা শিক্ষার্থীদের গ্রন্থাগারে আসা যাওয়া কম। তাছাড়া গ্রন্থাগারের যেসকল নিয়মকানুন রয়েছে সেটা শিক্ষার্থীদের জন্য ইতিবাচক বলেও মনে হয় না আমার। তাই গ্রন্থাগারের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ নেই শহরে থাকা শিক্ষার্থীদের।’
এদিকে ক্যাম্পাসে এবং এর আশপাশে থাকা প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থীদেরও গ্রন্থাগারে তেমন আগ্রহ নেই। আর এজন্য শিক্ষার্থীরা প্রথমেই দুষছেন গ্রন্থাগারের উদ্ভট সব নিয়মকে।
এ ব্যাপারেচবির সহকারী গ্রন্থাগারিক মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বড় যেকোনো গ্রন্থাগারে এমন নিয়মকানুন থাকে। কারণ এখানে অনেক পুরোনো বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে। এগুলো সংরক্ষণ করা এবং কারও প্রয়োজনে এসব বই দিয়ে সহযোগিতা করাই আমাদের দায়িত্ব। তাই নিয়মগুলো সেভাবেই করা হয়েছে। যাতে করে কোনো বই হারিয়ে না যায়।’
বই দেখে নেওয়ার সুযোগ না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিটি বইয়ের একটা কোড দেওয়া আছে। আর বইগুলো কোর্ড অনুযায়ী সাজানো থাকে। তাই বই দেখে নিতে গেলে সেটা এলোমেলো হয়ে যাবে। আর তখন লক্ষাধিক বই থেকে পরবর্তীতে একটা বই কেউ চাইলে আমরা এনে দিতে পারবো না।’
গ্রন্থাগারের প্রতি শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে অনলাইনেই সকল বই পাওয়া যায়। তাছাড়া অধিকাংশ বিভাগের নিজস্ব সেমিনার গ্রন্থাগার থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা হয়তো গ্রন্থাগারে আসার প্রয়োজন মনে করে না। তবে অনেকে গ্রুপ স্টাডি করতে এসে থাকে। আর যারা সত্যিই পড়তে চায় তারাই গ্রন্থাগারে আসে। এখানে লাইব্রেরির নিয়মকে দোষ দেয়ার কোনো কারন নেই।’
সহকারী গ্রন্থাগারিক জানান, ‘গ্রন্থাগারের সেবা বৃদ্ধির জন্য লাইব্রেরী কার্ড বা টোকেনের ব্যবস্থা করার চিন্তা ভাবনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের।
তবে শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, চার লাখ বই ও প্রায় ৭৫ হাজার জার্নালের সমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারকে প্রশাসন চাইলেই শিক্ষার্থীদের নিকট জনপ্রিয় করে তুলতে পারে। এজন্য প্রয়োজন প্রশাসনের যথাযথ উদ্যোগ। এক্ষেত্রে কাউন্সিলিং এবং শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরী নির্ভর পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ করতে শিক্ষকদের ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের অনলাইনে সকল বইয়ের নাম, বইয়ের নির্দিষ্ট কোড, লেখকের নামসহ পাওয়া যাবে এই লিংকে। এতে সার্চ করে লাইব্রেরী ক্যাটালগ সার্চ অপশনে গিয়ে লেখকের নাম বা বিষয় লিখলেই সেই সম্পর্কিত সকল বইয়ের তালিকা পাওয়া যাবে।