নার্স নয়, লাশ হয়ে ফিরলেন স্বজনদের কাছে
সিলেট নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী ফাহমিদা ও সানজিদা। একই কলেজে পড়ার সুবাধে ঘনিষ্ঠভাব ছিলো তাদের উভয়ের মাঝে। কলেজেও সবসময় একসঙ্গে থাকতেন তারা। লেখাপড়া খাওয়া-দাওয়া সবকিছু ছিল একসঙ্গে। নার্সিংয়ের উচ্চতর একটি প্রশিক্ষণ নিতে রোববার রাত ১০টায় আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন দুইজন। বসেছিলেন পাশাপাশি সিটে। কিন্তু স্বপ্ন পূরণ করে নার্স হয়ে নয়, লাশ হয়ে ফিরলেন পরিবার-স্বজনদের কাছে।
রোববার রাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচালে এক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় সেই স্বপ্ন নিমিষেই শেষ হয়ে যায় তাদের। একসঙ্গে দুই বান্ধবীর মৃত্যুতে পরিসমাপ্তি হলো সম্পর্ক এবং স্বপ্নের।
ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভা সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার জালালপুরের আব্দুল্লাহপুর গ্রামের আব্দুল বারীর মেয়ে। আর সানজিদা আক্তার বাগেরহাট জেলার মোল্লারহাট থানার আতজুরি ভানদর খোলা গ্রামের মো. আকরাম মোল্লার মেয়ে। তারা দুইজন সিলেট নার্সিং কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচালে যখন ট্রেন পৌঁছে তখন রাত প্রায় পৌনে ১২টা। যথা নিয়মেই ট্রেন চলার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। স্থানীয় রেলস্টেশন সংলগ্ন কালামিয়া (ফুলেরতল) বাজারের অধিকাংশ দোকানপাট তখন বন্ধ। আশপাশের গ্রামবাসী অনেকেই তখন ঘুমে। আবার কেউ কেউ নিচ্ছিলেন ঘুমের প্রস্তুতি।
কুলাউড়ার বরমচাল রেলওয়ে স্টেশন পাড়ি দিয়ে প্রায় ২০০ গজ সামনে যেতেই ইসলামাবাদ গ্রামের বড়ছড়া রেলওয়ে ব্রিজে ওঠার আগেই ব্রিজ ভেঙে বিকট শব্দে ট্রেনটির পেছনের তিনটি বগি ছিটকে পড়ে যায় খালে। আরও তিনটি বগি দুমড়েমুচড়ে রেলসড়কের পাশেই পড়ে যায়। অন্য দুটি বগি ব্রিজের দক্ষিণ পাশেই লাইনচ্যুত অবস্থায় কাত হয়ে কোনোরকম দাঁড়িয়ে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনের পেছনের বগিতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আর ধোঁয়ার কুণ্ডলী। চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয় ছয়টি বগি। এই ছয়টি বগি পড়ে যাওয়ার পর সামনের ১১টি বগিই ওই দুর্ঘটনার স্থল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার যাওয়ার পর থেমে যায়। সেই সঙ্গে থেমে যায় ফাহমিদা ও সানজিদার স্বপ্ন।
জালালপুরের ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভার লাশ সোমবার যখন তার পরিবারের সদস্যরা বাড়িতে নিয়ে যান তখন আব্দুল্লাহপুর গ্রামের আকাশ-বাতাস কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে। স্বজনরা মাটিতে লুটে পড়েন। পরিবারের অনেকেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন, কেউ কেউ শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছেন। তাদের দেখতে আসা কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
নিহত ফাহমিদার ভাই আব্দুল হামিদ বলেন, রাতে ট্রেন দুর্ঘটনার খবর পেয়ে বোনের খোঁজে ঘটনাস্থলে যাই। সেখানে বোনকে না পেয়ে কুলাউড়া হাসপাতালে এসে নিহতদের মধ্য থেকে বোনকে শনাক্ত করি। বিশ্বাস করতে পারছি না, আমার বোনটি আর দুনিয়াতে নেই।
এদিকে, বাগেরহাটের সানজিদা আক্তারের লাশ গ্রহণ করতে নার্স নেতৃবৃন্দ যখন কুলাউড়া হাসপাতালে যান তখন হাসপাতালেই এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। সেখান থেকে বিকেল ৩টায় অ্যাম্বুলেন্সযোগে সানজিদার লাশ ওসমানীতে নিয়ে আসা হয়। তখন তাদের সহপাঠীর লাশের সামনে কান্নার রোল পড়ে যায়। ওসমানী হাসপাতালেই তার লাশকে গোসল দেয়া হয়।
সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টায় সানজিদার প্রিয় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান সিলেট নার্সিং কলেজে তার প্রথম জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তার লাশ ওসমানী হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়। পরিবারের সদস্যরা আসার পর মঙ্গলবার সকালে তার লাশ হস্তান্তর করা হবে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শাখার সাধারণ সম্পাদক ইসরাইল আলী সাদেক।