০৮ জুন ২০১৯, ১০:১৯

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরিকল্পিত বিভাগ কার স্বার্থে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের যাত্রা ২০১২ সালে। এর দুই বছর পর ২০১৪ সালে খোলা হয় কমিউনিকেশন ডিসঅর্ডারস বিভাগ। এর এক বছরের মাথায় খোলা হয়েছে প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশনস স্টাডিজ বিভাগ। এ তিনটি বিভাগ খোলা হয়েছে মূলত সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে। বিভাগগুলোর চেয়ারম্যান ও শিক্ষক নিয়োগও হয়েছে সেখান থেকে। এর আগে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের কোর্স হিসেবে পড়ানো হলেও চার বছরের মধ্যেই কোর্সগুলোকে বিভাগে রূপ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।

অভিযোগ রয়েছে, কিছু শিক্ষকের দ্রুত চেয়ারম্যান হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ এবং নতুন শিক্ষক নিয়োগের জন্য পদ সৃষ্টির মতো বিষয়গুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে এসব বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,  দেদারসে বিভাগ খোলা হয়েছে। এসব বিভাগের সিলেবাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে একটি বিভাগই যথেষ্ট। যেসব বিষয়ে পাঠদানের জন্য একটি কোর্সই যথেষ্ট, সে বিষয়েও বিভাগ খোলা হয়েছে। কাউকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়ার জন্য কিংবা কয়েকজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য ব্যক্তিস্বার্থে এগুলো করা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, ভাষা ইনস্টিটিউট খোলা হয়েছিল ভাষা শেখানোর জন্য। এখানে বিভিন্ন ভাষার ওপর সার্টিফিকেট কোর্স করানোর কথা। এখন একেকটি ভাষার ওপর বিভিন্ন বিভাগ খোলা হচ্ছে। এগুলো সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। এভাবে অপ্রয়োজনীয় বিভাগ খোলায় শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভায় এসব বিষয়ে আলোচনা করে অপ্রয়োজনীয় বিভাগগুলোকে একীভূত করতে হবে।

একই চিত্র ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ ও দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের ক্ষেত্রেও। বিষয়বস্তু এক হলেও গড়ে তোলা হয়েছে দুটি উপ-প্রতিষ্ঠান।  কাঠামোগত দিক থেকে বিভাগটিতে পাঠদান ও গবেষণা এবং ইনস্টিটিউটটিতে উচ্চতর গবেষণা হওয়ার কথা। যদিও ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম চলছে অনেকটা বিভাগের মতোই। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় ইনস্টিটিউটে। একই বিষয়ে দুটি স্নাতক কোর্স পরিচালনা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে।

ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইনস্টিটিউট আর বিভাগের মধ্যে পার্থক্য করাটা কঠিন। কেননা আমাদের দেশে গবেষণা খাতে বরাদ্দ থাকে না। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও গবেষণাগার সুবিধাও অপ্রতুল। তাই আমরা শিক্ষার্থী ভর্তি করে শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের মাধ্যমে তাদের তাত্ত্বিক বিষয়ে জ্ঞানদান করি। পাশাপাশি চেষ্টা করি নিজস্ব অর্থায়নে গবেষণার।

ইনস্টিটিউট যদি বিভাগের মতোই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করে পাঠদান কার্যক্রম চালায়, তাহলে তাকে ইনস্টিটিউট বলা যাবে কিনা, সে প্রশ্ন তোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল। তিনি বলেন, ইনস্টিটিউটের কাজ হলো উচ্চতর গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা। সেটা না হলে ইনস্টিটিউটকে বিভাগ করে দিলেই তো হয়।

২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে প্রকৌশল অনুষদের অধীনে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগ নামে একটি বিভাগ চালু করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বিভাগটি চালুর প্রতিবাদে তখন বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও ক্লাস বর্জনও করেছিলেন ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (এপিইই) বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি ছিল, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইইই বিভাগে যে কারিকুলাম পড়ানো হয়, তাদেরও সেই কারিকুলামেই পড়ানো হয়। তাদের সিলেবাসের ১০ শতাংশ ফলিত পদার্থবিজ্ঞানের আর বাকি ৯০ শতাংশই ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের। পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত শিক্ষাবর্ষে দুটি বিভাগকে একীভূতকরণ করতে বাধ্য হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নতুন করে খোলা আইন ও ভূমি প্রশাসন, শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়াবিজ্ঞান, জীব ও চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব বলেন, বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে সবার আগে উচিত প্রয়োজনীয়তা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিভাগ খোলার প্রেক্ষাপট দেখলে বোঝা যায়, সেখানে ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে। নতুন একটি বিভাগ খোলা সহজ কথা নয়। সেখানে দক্ষ শিক্ষক ও পর্যাপ্ত অবকাঠামোর প্রয়োজন। তবে আমরা দেখছি অবকাঠামো ছাড়াই দুয়েকজন শিক্ষক নিয়েই বিভাগ খোলা হচ্ছে। এত কমসংখ্যক শিক্ষক কীভাবে কারিকুলাম প্রণয়ন করবেন, কীভাবে পাঠদান করবেন—এগুলো আমার বোধগম্য নয়। এভাবে বিভাগ খোলা অন্যায়। এটি শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও এক ধরনের প্রতারণা। এটিকে একাডেমিক ডিসঅনেস্টি বলা যায়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত সাত বছরে নতুন সাতটি বিভাগ চালু হয়েছে। নতুন চালু হওয়া বিভাগগুলো হলো মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স, শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান, সংগীত, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ক্রিমিনোলজি ও বাংলাদেশ স্টাডিজ। এ বিভাগগুলোর প্রত্যেকটিতেই রয়েছে অবকাঠামো সংকট।

কর্মমুখী শিক্ষা কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রধান সহায়ক। তবে কর্মবাজারের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা তরুণদের চাকরির সুযোগ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অপ্রয়োজনীয় বিভাগ খোলায় উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যেও বেকারত্বের হার বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমদ চৌধুরী বলেন, একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্ব হলো জাতীয় চাহিদার কথা বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে এমন কোনো পরিকল্পনা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাকরির বাজারের কথা বিবেচনায় না নিয়ে ইচ্ছামতো বিভাগ খুলছে। কর্মসংস্থানমুখী বিভাগ না খোলায় সব গ্র্যাজুয়েট সরকারি কিংবা ব্যাংকের চাকরির পেছনে ছুটছে। আমি কোনো বিভাগকে ছোট করব না। জ্ঞানের জগতে সব বিষয়েরই প্রয়োজন ও সম্মান রয়েছে। তবে বিশ্বের অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রয়োজনীয়তার নিরিখে অনেকগুলো বিভাগকে একীভূত করে ফেলে। আবার অনেক বিভাগ বন্ধ করে দেয়। অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পূর্ণ উল্টো পথে চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্যকলা ও সংগীত বিভাগকে ভাগ করে দুটি বিভাগ করা হয়েছে। উর্দু ও ফারসিকে ভাগ করে দুটি করা হয়েছে। পালি ও সংস্কৃতকে দুটি বিভাগ করা হয়েছে। অথচ এসব বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের কোনো উপকারে আসবে না।