সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাবে প্রাণের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা থাকলেও সেটি চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) হিসেবে আত্মপ্রকাশ পায়। এরপর দীর্ঘ প্রায় ৪৪ বছর প্রতিক্ষার পর ২০০৬ সালের ২৮ মে দেশের ২৬তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি)। যতদূর চোখ যায় ছোট-বড় পাহাড়ের হাতছানি। তার মাঝে সবুজ গাছগাছালি যেন পাহাড়ের সেই সৌন্দর্যকে শতগুন বাড়িয়ে দিয়েছে।
চারদিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। লালমাই পাহাড়ের পাদদেশ ঘিরেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মধ্য-পূর্বাঞ্চলের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। চলতি বছরের ২৮ মে ১৪ বছরে পা দিয়েছে পাহাড় আর সমতলের এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, সকল প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। এ নিয়ে নিজেদের চিন্তা-ভাবনা এবং প্রত্যাশা জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস’র পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরেছেন শাহাদাত বিপ্লব।
আদনান কবীর সৈকত, সিএসই বিভাগ
(সভাপতি, কুমিল্লা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি)
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন প্রাক্তন কিংবা বর্তমান শিক্ষার্থীর কাছে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপনের আনন্দ অনেকটা নববর্ষ উদযাপনের মতোই। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম একজন শিক্ষার্থীর নিজের নামের পরপরই তার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়, সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে প্রতিটি শিক্ষার্থীরই থাকে সীমাহীন স্বপ্ন ও প্রত্যাশা।
সদ্য ১৩ থেকে ১৪ বছরে পা রাখা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতা কিংবা ব্যার্থতার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব করার চেষ্টা করা কতটা যৌক্তিক হবে জানি না। তবে বিশ্বায়নের এই যুগে দাঁড়িয়ে নিজের ব্যার্থতা কিংবা অপরিপক্কতার জন্য সময় স্বল্পতার দোহাই দেয়া আর নিজেকে নিজে ফাঁকি দেয়ার মধ্যে যে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই, এটুকু খুব ভালো করেই অনুধাবন করতে পারি।
একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে দাঁড়িয়ে পরিপতক্কতার জন্য সময় প্রার্থনা করার কোন সুযোগ কারোরই নেই, এ যুগে আপনাকে পরিপক্ক হয়েই জন্মাতে হবে। আর এটিই চরম বস্তবতা। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে শিক্ষার মান উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক নিজস্ব সংস্কৃতি তৈরির প্রক্রিয়ার অগ্রগতি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলায় কোনভাবেই সন্তোষজনক নয়।
এর মধ্যে সবচাইতে পীড়াদায়ক বিষয় হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্রমাগত অবনতি, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, শিক্ষার্থীবান্ধব নীতির অভাবে বিগত বছরগুলোতে শিক্ষার্থীদের প্রায় কোন আন্দলনের সফল পরিসমাপ্তি না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উপর আস্থাহীনতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধুঁকতে থাকা, যার ফলে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের সামাজিকায়ন প্রক্রিয়া চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে ।
এতসব সংকটের পরও আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সামনের দিনগুলোতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনা সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য যে মেগা প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে, সেটির সঠিক বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় একটি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, আজকের এই দিনে এটিই আমার মত সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাওয়া। অনেক অনেক শুভকামনা, শুভ জন্মদিন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
শাহরীমা আলম শশী
চতুর্থ বর্ষ, একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ)
কোথায় যেন পড়েছিলাম ‘মানুষ বাঁচে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত’। মনে হয়, কথাটা শতভাগ সত্য। আমাদের রঙ্গিন সময়গুলোই কাটে ক্যাম্পাসের স্বল্প এই জীবনে। এত বন্ধু, এত আড্ডা, এত করে গল্প! বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরুলেই এ সোনালী সময় ফিরে পাওয়া অনেক দুষ্কর হয়ে পড়ে এই ব্যস্ততম বাস্তবতায়।
সারাদিনের ক্লাস-পরীক্ষার ক্লান্তি শেষে পাহাড়ের ঢালে সবুজে ঢাকা কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, টিলার উপর ছোট কুটিরের বাবুই চত্বর, শেষ বিকেলে পশ্চিম দিগন্তের ওপাড়ে সূর্য ডুবার মনোমুগ্ধকর রক্তিম দৃশ্য দেখার সানসেট ভ্যালি, শহীদ মিনারের পাদদেশে লাল ইটের উঠান, পহাড়ের উচুতে খেজুর তলার লালন চত্বর, নয়ত কোনো চায়ের টং, এ যেন শোরগোল আর আড্ডায় মেতে উঠা নতুন এক স্বপ্নপুরী। এই আড্ডা চলে বিকেল গড়িয়ে রাত পর্যন্ত। আড্ডাই যেন দূর দূরান্ত থেকে আসা জ্ঞান পিপাসুদের শত ক্লান্তির শেষ খোরাক। সকল ধরনের পূর্ণতা-অপূর্ণতা নিয়ে ক্যাম্পাসই যেন এ এক নতুন গল্প বুনার নাম।
এদিকে মানুষ যেমন বাচে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত, ঠিক তেমনই সকল ধরনের জ্ঞান অর্জনেরও স্বর্ণসময় জীবনের এ পর্ব। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে গবেষণায় সমৃদ্ধি। তবে তা থেকে অনেকটা বঞ্চিত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। যার কারণে পুথীগত বিদ্যা আমাদের একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাড়িয়েছে। আর তা থেকে মুক্তির আমাদের একমাত্র মাধ্যম গবেষণাধর্মী শিক্ষা ব্যাবস্থা।
সাইয়েদ মাখদুম উল্লাহ,
আইসিটি বিভাগ(সাবেক সভাপতি, কুমিল্লা ইউনিভার্সিটি আইটি সোসাইটি):
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিলো দেশের ২৬তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। বর্তমানে শুধু মধ্য-পূর্বাঞ্চলেরই নয় বরং সমগ্র বাংলাদেশে ছাড়িয়ে, নেপালসহ দেশের বাইরের জ্ঞান পিপাসুরা ভিড় জমাচ্ছেন লাল পাহাড়ের পাদদেশের এই অনিন্দ্য সুন্দর বিদ্যাপীঠে। সুপ্রাচীন শালবন বিহার ঘিরে অত্র অঞ্চলে শিক্ষার যে আলো জ্বলে উঠেছিলো সে আলো আজ বহুগুণে উদ্ভাসিত।
তুলনামূলক নবীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরোদমে চলছে অবকাঠামো উন্নয়ন, এরই মধ্যে ১৬৫০ কোটির আধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প এসেছে। এর বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণ বিশ্বমানে উন্নত হবে ইনশাআল্লাহ। শিক্ষা, সম্প্রতি, নৈতিকতা ও সাফল্যের মাত্রা প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে নিচ্ছেন মেধাবী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা । পাহাড়ে পাহাড়ে প্রাণচঞ্চল ঐতিহাসিক শালবনবিহার কোল ঘেষে গড়ে উঠা এ বিদ্যাপীঠের এখন শুধুই এগিয়ে যাওয়ার সময়।
প্রজ্ঞা পারমিতা,
তৃতীয় বর্ষ, লোক প্রশাসন বিভাগ
বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির সাথে জড়িয়ে আছে এক গভীর অনুভূতি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই জগত ও জীবন সম্পর্কে আরও বিস্তৃত ধারণা পাই আমরা। এখান থেকেই বুঝতে পারি আমাদের এগিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্র কি!
আজ থেকে তিন বছর আগে এসেছিলাম এই নবীন ক্যাম্পাসে। অনেকটা স্বচক্ষেই দেখেছি ছোট্ট এই ক্যাম্পাসটার চড়াই, উৎরাই। আমরাও প্রতিনিয়ত শিখছি ক্যাম্পাসের অলিগলি থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কোনো অনুভূতি প্রকাশের কথা ভাবলেই আমার চোখে ভাসে একটি সবুজ মাঠ, যেখানে একদল শিক্ষার্থী গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কারো হাতে গিটার, কারো হাতে জীবনানন্দ দাশের বই অথবা কারো গলায় ভেসে আসা ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা...’-এ গানটি।
আমাদের ৫০ একরের এই ছোট্ট ক্যাম্পাসটা ১৪ বছরে পা দিয়েছে। প্রকৃতির অকৃত্রিম মায়া দিয়ে সাজানো ভালোবাসার এই ক্যাম্পাসটা এখনো পুরোপুরি গোছানো হয়ে উঠেনি। প্রকৃতির এই দানকে আমরা এখনো নিজেদের হাতে সাজিয়ে তুলতে পারিনি ভালোভাবে। এতে প্রয়োজন প্রশাসনের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। এখানে নানা সংকট রয়েছে। রয়েছে শিক্ষাসামগ্রীর অভাব।
পেছনের সব অপ্রাপ্তিকে ভুলে আরও নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাবে আমাদের ক্যাম্পাস। এটাই একমাত্র প্রত্যাশা।