‘বৃত্ত’ কুবির আলপনায় চির অম্লান শহীদ ওসমান হাদি
দেয়ালের গায়ে লাল আর কালোর রঙে আঁকা এক দৃশ্য, যেন হঠাৎই ক্যাম্পাসের নীরবতা ভেদ করে উঠে আসে এক তীব্র উচ্চারণে। পথচারী থমকে দাঁড়ায়, দৃষ্টি আটকে যায় সেই গ্রাফিতিতে। দেয়ালের মাঝখানে এক বক্তার অবয়ব—দুই হাত ছড়িয়ে দেওয়া, সামনে মাইক্রোফোন, মুখে উচ্চারণের দৃপ্ত ভঙ্গি। ধূসর-সাদা রেখায় আঁকা শরীরটি স্পষ্ট, অথচ আবেগে পূর্ণ। লাল পটভূমি পুরো দৃশ্যটিকে দিয়েছে প্রতিবাদ, রক্ত আর উত্তেজনার ভাষা। মনে হয়, দেয়াল নিজেই হয়ে উঠেছে এক মঞ্চ আর সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন এক বিদ্রোহী কণ্ঠ, এক আপসহীন আত্মা।
গ্রাফিতির সেই ব্যক্তি আর কেউ নন, তিনি শহীদ ওসমান হাদি। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ ওসমান হাদি ছিলেন দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও দেশপ্রেমের এক অগ্র সেনানি। তিনি ছিলেন এমন এক কণ্ঠস্বর, যিনি নির্ভীকভাবে কথা বলেছেন অন্যায় ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। ভারতীয় আধিপত্যবাদসহ সব ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে তার উচ্চারণ ছিল স্পষ্ট ও আপসহীন। তবু তার বিপ্লবে ছিল না প্রতিহিংসা; ছিল ন্যায়বোধের গভীরতা। তিনি স্বপ্ন দেখতেন একটি ইনসাফভিত্তিক সমাজের, যেখানে শত্রুর সঙ্গেও জুলুম করা হবে না, যেখানে প্রতিশোধ নয়, ন্যায়ই হবে শেষ কথা।
এই ইডিওলজির মানুষটিকেই ১২ তারিখে, জুমার নামাজ শেষে, আততায়ীরা নির্মমভাবে গুলি করে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সিঙ্গাপুরে। জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থেকেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন অদম্য এক প্রেরণার নাম। অবশেষে ১৯ ডিসেম্বর, চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন। নিভে যায় একটি কণ্ঠ, কিন্তু জেগে ওঠে হাজারো উচ্চারণ। প্রতিটি তরুণ-ই এখন হাদী হতে চায়! কিন্তু এখনো তার হত্যাকারীদের ধরতে পারেনি বাংলাদেশ প্রশাসন।
গ্রাফিতির বাঁ পাশে কালো দেয়ালে সাদা অক্ষরে লেখা নজরুলের সেই অমর চরণ—
‘আমি চির-বিদ্রোহী বীর,
আমি বিশ্ব ছাড়ায় উঠিয়াছি এক
চির উন্নত শির!’
এখন এই পঙ্ক্তিগুলো কেবল নজরুলের বিদ্রোহী পঙ্ক্তি নয়; এগুলো শহীদ ওসমান হাদির জীবনেরই বাস্তব প্রতিচ্ছবি। তার মুখনিঃসৃত শব্দ, তার সংগ্রাম, তার আত্মত্যাগ সবকিছু যেন এই কয়েকটি চরণে এসে মিলেছে। দেয়াল তখন আর নিঃশব্দ থাকে না; দেয়াল হয়ে ওঠে স্মৃতি, সাক্ষ্য আর শপথের ভাষা।
গ্রাফিতি মূলত দেয়ালে আঁকা ছবি বা লেখা কিন্তু তার তাৎপর্য কেবল রঙ আর রেখায় সীমাবদ্ধ নয়। এটি সময়ের দলিল, জনমানুষের ভাবনার প্রকাশ। গ্রিক-রোমান সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক নগরজীবন পর্যন্ত গ্রাফিতি শিল্পীরা তাদের দেয়ালকে বানিয়েছেন প্রতিবাদের ক্যানভাস। যুদ্ধবিরোধী অবস্থান, অন্যায়–অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ কিংবা শান্তির আহ্বান, সবই জায়গা পেয়েছে এই শিল্পমাধ্যমে।
এই ধারাবাহিকতারই এক অনন্য প্রকাশ ঘটেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) লালমাটির ক্যাম্পাসে। এখানকার শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘বৃত্ত’ বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে এঁকেছে বিভিন্ন গ্রাফিতি, যেখানে রঙের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইতিহাস, সংস্কৃতি আর সংগ্রামের চেতনা। শহীদ ওসমান হাদির এই গ্রাফিতি তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
‘বৃত্ত’ মূলত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ও সংস্কৃতিমনা আঁকিয়ে শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠন। তারা বিশ্বাস করে, শিল্প কেবল সৌন্দর্যের অনুষঙ্গ নয়, এটি প্রতিবাদের ভাষা, স্মৃতির ধারক এবং ভবিষ্যতের জন্য বার্তা। নিয়মিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণকে নান্দনিক করে তোলার পাশাপাশি তারা গড়ে তুলতে চায় একটি প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক পরিবেশ, যেখানে দেয়ালও কথা বলবে, রংও প্রশ্ন তুলবে।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের দেয়ালে এঁকেছে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির’ গ্রাফিতি, ক্যাফেটেরিয়ার দেয়ালে ফুটিয়ে তুলেছে কিংবদন্তিদের চিত্র এবং ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনকে স্মরণে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং ক্যাম্পাস গেটে এঁকেছেন ‘ভাষা সংগ্রামের চিত্র’। বাংলার বিভিন্ন সংস্কৃতিকে মানসপটে ধারণ করার জন্য বৈশাখে আঁকেন ‘নবান্ন গ্রাফিতি’। তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে গ্রাফিতি বেশি সাড়া ফেলেছে, সেটি হচ্ছে ‘চিঠি চত্বর’।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গ্রাফিতিগুলো হলো সময়ের সাক্ষ্য। লাল আর কালোর মিশ্রণে আঁকা শহীদ ওসমান হাদির অবয়ব আমাদের মনে করিয়ে দেয় – বিপ্লবীরা কখনো মরে না। সে রং হয়ে ফিরে আসে, শব্দ হয়ে জেগে ওঠে, আর দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে দেয় এক অনিবার্য আহ্বান।
শহীদ ওসমান হাদি নেই, তবু তাঁর উচ্চারণ থেমে নেই। ‘বৃত্ত’ কুবির আলপনায় চির অম্লান থেকে যাবে শহীদ হাদি।