সমালোচনা করলেই সিট বাতিলের হুমকি খুবি হল প্রভোস্টের
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) বিজয় ২৪ হলে সেবা ঘাটতি ও প্রশাসনের আচরণ নিয়ে সমালোচনামূলক পোস্ট দেওয়ার পর দুই শিক্ষার্থীকে পৃথক কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে হল প্রশাসন। অভিযোগ উঠেছে হলে জরুরি সহায়তা না থাকা এবং অসুস্থ এক ছাত্রীকে বহনে স্ট্রেচার না পাওয়ার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং সিট বাতিলের হুমকি দেওয়া হয়।
৩১ অক্টোবর রাতে অপরাজিতা হলের শিক্ষার্থী নন্দিনী মণ্ডল অনুমতি ছাড়াই বিজয় ’২৪ হলে প্রবেশ করেন। করিডোরে অসুস্থ হয়ে পড়লে হলের কয়েকজন ছাত্রী তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যান। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, তখন স্ট্রেচার পাওয়া যায়নি। চিকিৎসার পর নন্দিনীকে রেজুয়ানা খন্দকারদের রুমে রাখা হয়।
ঘটনার পর তাসনিম বুশরা একটি ফেসবুক গ্রুপে লিখেন, ‘একটি হলে যেখানে ট্রেডমিল, সবজি বাগান, ইয়োগা রুম ইত্যাদি দিয়ে বাহবা দেয়া প্রদান করা হয়, সেখানে অসুস্থ ছাত্রীকে বহন করার মতো স্ট্রেচার পর্যন্ত নেই; ব্লাড প্রেশার মাপার ব্যবস্থাও নেই।’
উল্লেখ গত ২৬ অক্টোবর বিজয় ২৪ হলের সবজি, তরকারি চাষ ও ট্রেডমিল স্থাপনের বিষয়টি অনেক ফলাও করে প্রচার করা হয়। কিন্তু হলে জরুরি মুহুর্তে প্রয়োজনীয় জিনিসের ঘাটতি থাকার বিষয়টা সামনে আনতেই এই ঘটনার সৃষ্টি হয়।
২ নভেম্বর তাসনিমের পোস্টকে কেন্দ্র করে তাকে এবং মন্তব্যকারীদের প্রভোস্ট অফিসে ডেকে মোবাইল বাইরে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বলে জানান হলের অন্তত পাঁচ ছাত্রী। তারা অভিযোগ করেন, সিট বাতিলসহ বিভিন্ন হুমকিও দেওয়া হয়। ভয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা বিষয়টি প্রকাশ্যে বলেননি।
৪ নভেম্বর রেজুয়ানা খন্দকার ও তাসনিম বুশরাকে পৃথক শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নন্দিনী মণ্ডলকে মিথ্যা পরিচয়ে হলে প্রবেশ করানো, প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া হলে নিয়ে আসা এবং পরে উসকানিমূলক মন্তব্য করা। অন্যদিকে তাসনিম বুশরার বিরুদ্ধে হলের সেবা ঘাটতি সংক্রান্ত সমালোচনামূলক পোস্ট দিয়ে প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগ তোলা হয়। নোটিশে এসব কর্মকাণ্ডকে ‘হল আইন পরিপন্থী এবং নাশকতামূলক’ বলা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রী বলেন, অসুস্থ ছাত্রীটির নিজের হলে রুমমেটদের সঙ্গে সমস্যা ছিল, তাই তিনি বাধ্য হয়ে বিজয় হলে আসেন। তিনি আরও বলেন, ‘ম্যাডামকে আগে বলা হয়নি এটাই মূল ক্ষোভের কারণ। কিন্তু প্রয়োজনীয় সেবার ঘাটতির কথা বলা শৃঙ্খলাভঙ্গ বা নাশকতা হতে পাড়ে না। শৃঙ্খলা বিধির বাড়তি ক্ষমতাই এমন সিদ্ধান্তের পথ খুলে দিয়েছে।'
৫ নভেম্বর রেজুয়ানার শোকজ নোটিশের লিখিত জবাবকে ‘অসন্তোষজনক’ উল্লেখ করে ৯ নভেম্বর তাকে তদন্ত কমিটির সামনে আত্মপক্ষ সমর্থনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
১৫ নভেম্বর তাসনিম বুশরা ফেসবুকে একটি অনুশোচনামূলক বিবৃতি প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি আগের পোস্টকে ‘ভিত্তিহীন’ উল্লেখ করে প্রভোস্ট ও প্রশাসনের কাছে ক্ষমা চান। জানা যায়, তাকে ক্ষমা চেয়ে পোস্ট দিতে এবং তার স্ক্রিনশট প্রশাসনে জমা দিতে বলা হয়েছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা জানায় যে, সমালোচনা দীর্ঘদিন ধরেই দমন করা হচ্ছে। এর আগেও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিনের এক ছাত্রী হলের আইডি কার্ড নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিলে পুরো ডিসিপ্লিনের ছাত্রীদের প্রভোস্টের রুমে ডেকে ৩ ঘন্টা ধরে দাড়িয়ে রেখে সিট বাতিলের হুমকি দেওয়া হয়েছিল এবং সংশ্লিষ্ট ছাত্রীকে লিখিত দিতে বলা হয়েছিল যে তিনি এমন পোস্ট আর দেবেন না। এরপর থেকে হলের আর কোন আবাসিক শিক্ষার্থী প্রকাষ্যে প্রভোস্টের সমালোচনা করতে ভয় পাই।
বিজয় ’২৪ হলের প্রভোস্ট প্রফেসর ড. সাঈদা রেহানা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘তারা যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে, সে ধরনের কাজকে নাশকতা বলা হয়েছে, কারণ শৃঙ্খলা বিধিতে এভাবেই সংজ্ঞায়িত আছে। হলের প্রবেশ সময় রাত ৯টা, কিন্তু তারা ৯টা ৩০ মিনিটে অসুস্থতা অনুভব করে বাইরে যেতে চেয়েছে চা খেতে। অন্য হলের ছাত্রীও এই হলের পরিচয় লিখে প্রবেশ করেছে, অসুস্থ হওয়ার পরে তাকে মেডিকেল সেন্টারে নিবে তা না করে রুমের মধ্যে নিয়ে গেছে।’
ফেসবুকে করা সমালোচনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা গঠনমূলক সমালোচনা না করে আক্রোশের জায়গা থেকে সমালোচনা করেছে। আমি হলে প্রতিটি শিক্ষার্থীর ভালো চাই বলেই সবসময় তাদের দাবির প্রতি সাড়া দিই। কথায় কথায় সিট বাতিলের হুমকি আমি দিই না।’
মোবাইল জমা দিতে বলা হয়েছিল কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেকে মিটিং চলাকালে মোবাইল ব্যবহার করে, সেজন্যই টেবিলে রাখতে বলা হয়েছিল, বাহিরে রেখে যেতে বলা হয়নি।' ক্ষমা চাওয়ার পোস্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওই ছাত্রীকে পুনরায় ক্ষমা চেয়ে পোস্ট দিতে বলা হয়েছিল, তবে এত বিস্তারিত লিখতে বলা হয়নি। সামান্য কয়েকটি বাক্য লিখলেই যথেষ্ট হতো।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক পরিচালক প্রফেসর ড. নাজমুস সাদাত বলেন, ‘এ বিষয়টি নাশকতা মূলক হয়েছে বা শৃঙ্খলা বিধিতে এটাকে নাশকতামূলক বলা হয়েছে কিনা তা আমার কাছে মনে হয়না। ফেসবুকে একজন পোস্ট দিতেই পারে এর সমাধান হলো ভুলবশত এমন করলে তাকে হল কর্তৃপক্ষ ডেকে প্রোপার কাউন্সিলিং করতে পারেন তবে তারপরও যদি সমাধান না হয় তখন এটার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।’