২৪ এপ্রিল ২০১৯, ১৯:৩৯

সেই সাত কলেজের সংকট দুই বছরেও কাটেনি

  © লোগো

সেশনজট, গণহারে ফেল, নিজস্ব প্রশাসনিক ভবন, রুটিন প্রকাশসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে কিছুদিন পরপরই আন্দোলনে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত রাজধানীর সাত সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ, মঙ্গলবার থেকে ৫ দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। তবে বুধবার দ্বিতীয় দিনের তাদের দাবি আদায়ে আশ্বাস ঢাবি প্রশাসন আশ্বাস দিলে আন্দোলন আপাতত স্থগিত করেন। দুই বছরের বেশি সময়ের পরও সাত কলেজের সংকট কাটেনি। ফলে চরম হতাশা নিয়ে শিক্ষাজীবন পার করছে এসব কলেজের লক্ষাধিক শিক্ষার্থী।

জানা যায়, ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সাত সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত করা হয়। এগুলো হচ্ছে-ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। অধিভুক্ত হওয়ার পর থেকেই নানা সংকট লেগেই আছে এসব কলেজের। ফলে লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। এ কারণে তারা কখনও পরীক্ষার রুটিন, কখনও ফলের দাবিতে রাজধানীর নীলক্ষেত ও শাহবাগের মোড় অবরোধ করছে শিক্ষার্থীরা। এ আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে তিতুমীর কলেজের আবু বকর সিদ্দিক নামে এক শিক্ষার্থী চোখও হারিয়েছে। তবুও সুফল পায়নি সাত কলেজের লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর। তাই বারবার রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছে তারা। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ঢাবি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অবহেলায় তারা চরম হতাশা নিয়ে শিক্ষাজীবন পার করছে।

সর্বশেষ, ৫ দফা দাবিতে মঙ্গলবার থেকে আন্দোলনে মেনেছেন শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবারের পর বুধবারও রাজধানীর নীলক্ষেতে অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন তারা। জানা যায়, বুধবার বেলা ১১টায় দ্বিতীয় দিনের মতো বুধবার রাজধানীর নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। পরে বেলা দেড়টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী আন্দোলনস্থলে এসে তাদের আশ্বাস দেন। এসময় শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো লিখিত আকারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে জমা দেওয়ার আহ্বানও জানান তিনি।

এসময় প্রক্টর বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো নিয়ে আমরা ভিসি স্যারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আগামী রবিবার তোমাদের দাবি নিয়ে সিন্ডিকেট সভায় আলোচনা করা হবে। সেখানে সাত কলেজের প্রতিনিধিও রাখা হবে। এছাড়া তিনি সাত কলেজ সম্পর্কে ইতিমধ্যে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা লিখিত বক্তব্য আকারে পেশ করেন। পরে তারা অবরোধ আপাতত স্থগিত করে অবরোধ তুলে নেন। এদিকে, বিকেলে দাবিগুলো নিয়ে শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সঙ্গে দেখা করে। এসময় ভিসি তাদের দাবিগুলো মেনে নেয়ার আশ্বাস দেন এবং আন্দোলন না করে ক্যাম্পাসে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন।

আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সরকারি কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী অমলেন্দু পাল বলেন, নানা অনিয়মের প্রতিবাদে ও বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি। কিন্তু কোন সমাধান হয়নি। এ কারণে মঙ্গলবার থেকে আন্দোলন শুরু করেছি। তিনি বলেন, আমাদের দাবি নিয়ে একটি প্রতিনিধি দল বিকালে ভিসির সঙ্গে দেখা করেছি। উনি আমাদের দাবি আদায়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। তাই আমরা আপাতত আন্দোলন স্থগিত করেছি। তবে বিষয়টি আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হবে।

শিক্ষার্থীদের ৫ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে-পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে ত্রুটিমুক্ত ফলাফল প্রকাশসহ ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের ২০১৬ সালের অনার্স চতুর্থ বর্ষ এবং ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের ২০১৭ সালের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের লিখিত পরীক্ষাসহ সকল বিভাগের ফলাফল একত্রে প্রকাশ করা; ডিগ্রী, অনার্স, মাস্টার্স সকল বর্ষের ফলাফল গণহারে অকৃতকার্য হওয়ার কারণ প্রকাশসহ খাতার পুনর্মূল্যায়ন করা; সাত কলেজ পরিচালনার জন্য স্বতন্ত্র প্রশাসনিক ভবন; প্রতিমাসে প্রত্যেকটা বিভাগে প্রতি কলেজে দুইদিন করে মোট ১৪ দিন ঢাবির শিক্ষকদের ক্লাস নেওয়া; সেশনজট নিরসনের লক্ষ্যে একাডেমিক ক্যালে-ার প্রকাশসহ ক্রাশ প্রোগ্রাম চালু করা।

দাবি পূরণে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে: ঢাবির অধিভুক্ত সরকারি ৭ কলেজের যে সমস্যা রয়েছে তা স্বীকার করেছেন ঢাবি কর্তৃপক্ষ। এসব সমস্য সমাধানে কাজ করবেন বলে জানিয়ে বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ থেকে প্রেরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে সকল শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হয়েছে তাদের কিছু জটিলতার কারণে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় সাময়িক অসুবিধা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে তাদের এসব সমস্যা সমাধান করার উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া, অধিভুক্ত সরকারি ৭ কলেজের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে সকল বিষয়ের ফলাফল প্রকাশ করার ব্যাপারে ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যে সকল বিষয়ে অধিক হারে অকৃতকার্য হয়েছে, তদবিষয়ে আবেদনক্রমে পুনর্মূল্যায়নের ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, ‘সাত কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক ভবনে স্বতন্ত্র সেল গঠন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে সাত কলেজের জন্য স্বতন্ত্র নতুন ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। অধিভুক্ত সাত কলেজের সেশনজট নিরসনকল্পে ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ বিষয়ে কলেজ অধ্যক্ষদের সাথে আলোচনাক্রমে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের জন্য একাডেমিক ক্যালেন্ডার তৈরির কাজও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘২০১৬ সনের ৪র্থ বর্ষ অনার্স পরীক্ষার ফলাফল (সি.জি.পি.এ সমন্বয় করে) ইতোমধ্যেই প্রকাশ করা হয়েছে। ডিগ্রি ১ম বর্ষ ২০১৭ পরীক্ষার রুটিনও প্রকাশিত হয়েছে। মাস্টার্স ২০১৬ অনলাইনে ফরম পূরণ শুরু হবে ২৮ এপ্রিল ২০১৯ এবং পরীক্ষা শুরু হবে ১৭ জুন ২০১৯ থেকে। অনার্স ২য় বর্ষ ২০১৮ পরীক্ষা শুরু হবে ১৯ মে ২০১৯।’

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘আগামী রবিবার ভিসির সভাপতিত্বে সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সাথে এক সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান কল্পে করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। শিক্ষার্থীদের যে কোন ধরনের একাডেমিক ভোগান্তি লাঘবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সকল নিয়মতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করবে। তাই জনভোগান্তি নিরসনে শিক্ষার্থীদেরকে নিজ নিজ ক্যাম্পাসে থাকার জন্য আহ্বান জানানো যাচ্ছে।’

এ বিষয়ে মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজের শিক্ষার্থী শাহেদুল ইসলাম বলেন, আমরা অধিভুক্ত বাতিল চাই না। কিন্তু এই অধিভুক্তির ফলে প্রতিবছর যে সেশনজটের মধ্যে আমরা পড়ছি, এই সমস্যা সামনে যাতে না হয় এজন্য আমরা প্রশাসনের সহায়তা চাচ্ছি। আমরা যে সেশনজটের শিকার হয়েছি শুধু অধিভুক্ত বাতিল করলেই তো এখন আর সেই সময়গুলো আমরা ফিরে পাব না।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাত কলেজের এক অধ্যক্ষ বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার পর এসব কলেজে শিক্ষার গুণগত মান বেড়েছে, তবে পরিমাণগত মান বাড়েনি। একদিকে ক্লাসে উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধতা করা হয়েছে, কিন্তু ব্যাপক অকৃতকার্য হচ্ছে। আমরা চাই এসব দ্রুত সমাধান হোক।

এ বিষয়ে ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামান বলেন, সাত কলেজের কিছু জটিলতা এখনও রয়ে গেছে। আছে। তবে এসব সমাধানের লক্ষ্য কাজ চলছে। আশা করি দ্রুতই সমাধান হবে। আর শিক্ষার্থীরা যে দাবি রয়েছে তা মেনে নেওয়া হবে এবং সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য কাজ চলছে।