‘নিরাপদ বাস-ট্রেন দাও, নইলে মানচিত্র খাবো’
প্রতিবাদের ভিন্নধর্মী কিছু ভাষা কখনো কখনো নাড়া দেয় মানুষের বিবেক। আবার কখনো ইতিহাসের পাতায়ও স্থান পায় কিছু প্রতিবাদী স্লোগান। নতুন কোনো আন্দোলন কিংবা প্রতিবাদে সেই লাইনগুলো আবার ফিরে আসে। বাসের হেলপার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে ‘নিরাপদ বাস দাও, ট্রেনের বগি দাও, নইলে মানচিত্র খাবো’ ভাষাটাও হয়তো কারো বিবেকে নাড়া দিয়ে যাবে। উর্ধ্বতন কর্তাদের কাছে আরও একবার পৌঁছে যাবে এমন প্রতিবাদের কিছু ছবি, কিছু কথা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) থেকে নগরীর নিউ মার্কেটগামী ৩নং বাসের চালক ও হেলপার দ্বারা গত ১১ এপ্রিল লাঞ্ছিত হয় চবির অর্থনীতি বিভাগের এক ছাত্রী। এ ঘটনায় মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) দুপুরে চবির সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সামনে মানববন্ধন করেছে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। এসময় শিক্ষার্থীদের ‘নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, নিরাপত্তা চাই স্বাধীন দেশে’, ‘১৬ কোটি বাঙালির হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি’, ‘গণপরিবহনে যৌন নিপিড়ন, আর নয় আর নয়’ এহেন প্রতিবাদী স্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়।
অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আদনান আলীর সঞ্চালনায় ও বিভাগের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন মজুমদারের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন প্রক্টর অধ্যাপক আলী আজগর চৌধুরী, বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবুল হোসাইন, অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ নুর নবী, সহকারী অধ্যাপক নঈম উদ্দিন হাছান আওরেঙ্গজেব চোধুরী, ঝুলন ধর এবং বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ও ইয়ং ইকোনোমিস্ট সোসাইটির সাবেক সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মাসুম।
বক্তব্যে প্রক্টর অধ্যাপক আলী আজগর চৌধুরী বলেন, মেয়েটি তার সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। সেই সাথে বিভাগের সাবেক-বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাকে সহযোগিতা করেছে। আইনের বাস্তবায়নের জন্য যেকোনো জায়গা থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি হয়। তারপরেও আমরা চেষ্টা করি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয় যেকোনো প্রতিষ্ঠানকেই নেক্কারজনক কর্মকান্ড প্রতিহত করতে এগিয়ে আসতে হবে।
অধ্যাপক ড. আবুল হোসাইন বলেন, এটা শুধু নিন্দাযোগ্য কাজ নয়। সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দেরি হলেও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাবো বলে আমরা আশাবাদী। একজন সাহসী মেয়ের মত সে তাৎক্ষণিক আঘাত না করলে আরো খারাপ কিছু হতে পারতো। ছাত্রীদের দলবদ্ধ হয়ে বাসে যাতায়াত করতে হবে। ছাত্রদের উচিৎ এ ব্যাপারে তাদেরকে সহযোগিতা করা।
অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, এটা কোন নতুন ঘটনা নয়। এমন হয়রানির বা লাঞ্ছনার ঘটনা অহরহ ঘটছে। বর্ষা সাহসিকতা নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। মূলত প্রতিবাদ না করায় তারা প্রশ্রয় পায়। কোন হয়রানির ইঙ্গিত পেলেই সম্মিলিতভাবে এর প্রতিবাদ জানাতে হবে। এমনকি একা হলেও কেউ যেন প্রতিবাদ করতে ভয় না পায়। প্রয়োজনে বাসের চালক ও হেল্পারদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাউন্সিলিং দেয়া উচিত।
সহকারী অধ্যাপক ঝুলন ধর বলেন, বর্তমান প্রযুক্তির যুগে আইসিটি যেভাবে কাজ করছে অপরাধী সনাক্ত করা জটিল কোন বিষয় নয়। শুধু পুলিশের সদিচ্ছা ও দায়িত্ববোধের উপর এটা নির্ভর করে। এ ঘটনায় অভিযুক্তদের নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দেয়া হয়েছে। যার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও সর্বনিম্ন শাস্তি ১০ বছর কারাদণ্ড। তাই শুধু অপরাধীদের আটকেই শেষ করলে হবে না, বরং আইনের প্রয়োগ এবং শাস্তি কার্যকর করতে হবে।
ইয়াং ইকোনমিস্ট সোসাইটির (ইয়েস) সাবেক সভাপতি ও বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মাসুম বলেন, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সহায়তায় উক্ত ঘটনার পরপরই আমরা অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে ঘটনায় অভিযুক্ত বাস চালককে তাৎক্ষণিক আটক করাটাই সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
প্রসঙ্গত, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি প্রথম বর্ষের ওই ছাত্রী বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) বিকেলে ক্লাস শেষে বিশ্ববিদ্যালয় ১নং গেইট থেকে ৩নং বাসে ওঠেন। বাসটি নগরের রিয়াজুদ্দিন বাজার এলাকায় পৌঁছালে ভুক্তভোগী ছাড়া সব যাত্রী নেমে গেলে বাসটি তার রুট পাল্টে স্টেশন রোডের দিকে চলতে শুরু করে। ভুক্তভোগী নিরাপত্তার স্বার্থে ড্রাইভারকে বাস থামাতে বললে বাসের হেলপার তার দিকে ধেয়ে যায় এবং গলায় ওড়না পেঁচিয়ে তার শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করে।
দম বন্ধ হয়ে আসলে ভুক্তভোগী আত্মরক্ষার্থে হাতে থাকা মোবাইল দিয়ে হেলপারটিকে আঘাত করে চলন্ত বাস থেকেই লাফ দেয় এবং এক রিকশাওয়ালার সাহায্য নিয়ে বাসায় ফিরেন। ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বাদী হয়ে নগরীর কোতায়ালি থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। ঘটনায় বাস চালককে আটক করা হলেও হেলপারকে এখনো আটক করা হয়নি। এদিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ১৩ এপ্রিল বাস চালকের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।