ছাত্রলীগের হামলার এক বছর পরও ববি প্রশাসনের নীরবতা, শিক্ষার্থীদের অনাস্থা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক বছর পেরিয়ে গেলেও নানাভাবে বাধা প্রদান ও হামলাকারী নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) প্রশাসন। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের অনাস্থা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ না থাকায় কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আন্দোলনে বাধা প্রদান ও প্রত্যক্ষ হামলা চালায় নিষিদ্ধ ও সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীরা। আন্দোলন চলাকালীন তারা নানাভাবে আন্দোলনে বাধার সৃষ্টি করে এবং হামলা করে আন্দোলন বন্ধের চেষ্টা করে। তাছাড়া সরাসরি শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান নেয় তারা।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিন হল ২৯ জুলাই। সেদিন ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে গ্রাউন্ড ফ্লোরে মিটিংরত আন্দোলনের সমন্বয়কসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায় তারা। ঐদিন ১৫ জন আহত হয়ে শের-ই-বাংলা মেডিকেলে কলেজে চিকিৎসা নেয়।
এ ছাড়াও ১ আগস্ট বিক্ষোভ সমাবেশ করতে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় হয়রানি, হেনস্তা, ক্যাম্পাসে প্রবেশে বাধা প্রদান সহ পুলিশ প্রশাসনের সাথে মিলে আন্দোলন বানচাল করা ও সমন্বয়কদের পুলিশি গ্রেপ্তারে সহযোগিতা করে ছাত্রলীগের কর্মীরা।
এসব ঘটনার প্রমাণ থাকলেও, প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বললে তারা আরও জানান, এসব হামলাকারীদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। ক্যাম্পাসের আশেপাশে ঘুরতেও দেখা যায় অনেককে। যাদের হাতে এখনো শহিদের রক্ত লেগে আছে এবং ফ্যাসিস্টের দোসর হিসেবে যারা কাজ করেছে তাদের এইভাবে বিচারহীনভাবে পার পেয়ে যাওয়াকে শিক্ষার্থীরা হাজার হাজার শহিদদের রক্তের সাথে বেইমানি বলে মনে করছেন।
হামলায় আহত শিক্ষার্থী সূত্রে জানা যায়, আন্দোলন চলাকালীন সেসব হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ পরিচয়ধারী নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আবুল খায়ের আরাফাতের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করেন- আবিদ হাসান (গণিত বিভাগ; ২০১৫-১৬ সেশন), মাহমুদুল হাসান তমাল (আইন বিভাগ; ২০১৭-১৮ সেশন), আল সামাদ শান্ত (ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ; ২০১৭-১৮ সেশন), খালেদ হাসান রুমি (ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ; ২০১৭-১৮ সেশন), সাইফ আহমেদ (অর্থনীতি বিভাগ; ২০১৭-১৮ সেশন),সাব্বির হোসেন (বাংলা বিভাগ; ২০১৮-১৯ সেশন), শরীফুল ইসলাম (একাউন্টটিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ; ২০১৮-১৯), রাকিবুল হাসান (বাংলা বিভাগ; ২০১৮-১৯)।
এ ছাড়াও মার্কেটিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের টিকলী শরিফ, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী অশোক আলী, আইন বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শাহারিয়ার সান ও শেখ মোহাম্মদ সাইফ সহ নাম না জানা আরও ১০-১৫ জন সেসব হামলায় অংশ নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
হামলায় আহত শিক্ষার্থী মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আন্দোলন চলাকালীন ২৯ জুলাই ছাত্রলীগের কর্মীরা প্রক্টরিয়াল বডি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতেই আমাদের উপর এই ন্যাক্কারজনক হামলা চালায়। প্রক্টরিয়াল বডির নীরব ভূমিকাই বলে দেয় ববির তৎকালীন প্রশাসন হয় ছাত্রলীগের চেয়ে দুর্বল ছিল, নয়তো ছাত্রলীগকে মদদ দিচ্ছিল। হামলার পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, যা আমাদের হতাশ করেছে। পট পরিবর্তন হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখন পর্যন্ত কোনো লিগ্যাল অ্যাকশন নেয়নি। যা সুস্পষ্টভাবে ববি প্রশাসনের দুর্বলতার প্রমাণ অথবা বিপ্লবকে অবজ্ঞা।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি এসব হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে লিগ্যাল পদক্ষেপ নিতে কালক্ষেপণ করে, তাহলে ২৪ এর জুলাইয়ের আহতদের রক্তের সাথে প্রতারণা করা হবে। ববির ছাত্রসমাজ তা মেনে নিবে না।’
হামলায় আহত আরেক শিক্ষার্থী সুজন মাহমুদ বলেন, ‘ব্যাপারটি খুবই দুঃখজনক। ববিতে এখনো ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সেই রকম কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাইনি। আমি অনতিবিলম্বে এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষীদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. মুহসিন উদ্দীন বলেন, ‘২৯ জুলাই ছাত্রলীগ কর্মীরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়েছে। এ বিষয়ে থানায় একটি মামলা করা হয়েছে এবং এই মামলায় আমাদের সিকিউরিটি অফিসারকে বাদী করা হয়েছে। এই অভিযোগ যেহেতু থানার কাছে, সে বিচার তো বিশ্ববিদ্যালয় করবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ নাই। আর থানায় যাদেরকে সাক্ষী করা হয়ছে তারাও সাক্ষী দিতে যাচ্ছে না। যার ফলে থানা থেকে এখনো চার্জ শিট দিতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়েরও অভিযোগ না থাকায় অথরিটির কিছু করার সুযোগ হচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত বছর দু’জন শিক্ষার্থী প্রক্টরিয়াল দপ্তরে একটা অভিযোগ করেছিল। তখন এটা নিয়ে একটা কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু তদন্তে আহ্বায়ক বিদেশে চলে যাওয়ায় রিপোর্টটা জমা হয়নি। সে বিষয়ে গতকাল ভাইস-চ্যান্সেলরের উপস্থিতিতে আমরা প্রক্টরকে জানিয়েছি। তিনি বলেছেন, কমিটিকে রিফর্ম করে অথরিটিকে জানাবেন এবং এ ব্যাপারে প্রসিডিউর হবে বলে আমাদের জানিয়েছেন।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য অধ্যাপক তৌফিক আলমের কাছে ২ দিনে ৪ বার সাক্ষাৎ করতে চাইলেও ওনার সাক্ষাৎকারের সময় পাওয়া যায়নি।