২১ জুন ২০২৫, ১৪:৫৭

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘেঁষে চলছে অবৈধ ইটভাটা, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিক্ষার্থীরা

কুর্শা গ্রামে ইবনে তাইমিয়া দাখিল মাদ্রাসা  © সংগৃহীত

কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার কুর্শা গ্রামে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক এলাকার একেবারে পাশে ইটভাটার কার্যক্রম চলছে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে। সরকারি নীতিমালা ও আইনকে উপেক্ষা করে বছরের পর বছর ধরে ‘মেসার্স কামাল ব্রিকস’ নামে একটি ইটভাটা চালু রয়েছে। এতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে এলাকার শিক্ষার্থী, শিশু ও স্থানীয় বাসিন্দারা।

‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩’ অনুযায়ী, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা ও কৃষিজমির এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ সরকারি অনুমোদন, পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র কিংবা জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স ছাড়াই কুর্শা গ্রামের প্রাণকেন্দ্রে ‘মেসার্স কামাল ব্রিকস’ বছরের পর বছর ইট পোড়াচ্ছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, কুর্শা গ্রামে ইবনে তাইমিয়া দাখিল মাদ্রাসা, মাদ্রাসাতুল রিদওয়ান কওমি মাদ্রাসা, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং আবাসিক কুর্শা আদর্শ এতিমখানা রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক এলাকায় ১০ মিটারের মধ্যে গড়ে ওঠা ইটভাটার কারণে শিশুদের পড়ালেখা ব্যাহত হচ্ছে, পাশাপাশি তারা হাঁচি, কাশি, অ্যাজমা ও এলার্জির মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

শিক্ষার্থীরা জানায়, ধোঁয়া ও ধুলার কারণে শ্রেণিকক্ষে বসে নিঃশ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করে এবং জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খানের কাছে স্মারকলিপি দেয়। এমনকি পরিবেশ সচিব বরাবরও অভিযোগ পাঠানো হয়। তবু প্রশাসন আজও কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ।

মাদ্রাসাতুল রিদওয়ানের এক শিক্ষক জানান, দিনভর ধোঁয়া, শব্দ আর শ্রমিকদের চিৎকারের কারণে ক্লাস নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমনকি তারা আমাদের জমির একাংশ দখলও করেছে। প্রশাসনে একাধিকবার অভিযোগ করেও লাভ হয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, শিশুরা ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারছে না। ধোঁয়ার গন্ধে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বিকেল হলে শ্রমিকদের তাস খেলা ও আড্ডা হয়, যা পরিবেশকে আরও নোংরা করছে। জমির মাটি কেটে ইট তৈরির কারণে কৃষিজমিও কমে যাচ্ছে।

শামছুন্নাহার নামে আরেক নারী বাসিন্দা বলেন, আমরা চাই সন্তানরা সুস্থ পরিবেশে লেখাপড়া করুক। ইটভাটার ছায়ায় তাদের স্বপ্ন যেন চাপা না পড়ে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কুর্শা গ্রামের এই ভাটাটিসহ আশপাশের এলাকায় আরও কয়েকটি ইটভাটা রয়েছে, যেগুলোতে মূলত কাঠ পুড়িয়ে ইট প্রস্তুত করা হচ্ছে। ফসলি জমির মাটি অবৈধ ট্রলির মাধ্যমে সংগ্রহ করে সেখানে ইট তৈরি করা হচ্ছে। এর একটি উদাহরণ বনমালীপুর গ্রামের ‘মেসার্স সামিয়া ব্রিকস’। পরিবেশ অধিদফতর এর কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিলেও বাস্তবে তা অব্যাহত রয়েছে।

আরও জানা গেছে, মাত্র ৫০০-৬০০ মিটার দূরের আলতাফ ব্রিকসের চিমনি কোনও পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ কামাল ব্রিকস ভাটার বিরুদ্ধে দখল, দূষণ ও অনুমোদনহীনতার একাধিক অভিযোগ থাকলেও এখনও কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এ ঘটনাটি প্রশাসনের ‘একচোখা’ আচরণের প্রমাণ। এই ভাটার মালিক ইমরুল হাসান, যিনি নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নিকলী উপজেলা শাখার সাবেক সভাপতি। এছাড়া তিনি ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হকের ভগ্নিপতি কামাল হোসেন এবং বিয়াই জহিরুল হকের সঙ্গে ব্যবসায়িকভাবে জড়িত।

কামাল ব্রিকসের মালিক ইমরুল হাসানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

কিশোরগঞ্জ পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মো. মমিন ভূঁইয়া জানান, নিকলীতে পরিবেশ নীতিমালা না মানায় চারটি ইটভাটার লাইসেন্স ইতোমধ্যে বাতিল করা হয়েছে এবং তিনটি ভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে কামাল ব্রিকস নিয়ে একটি আইনি জটিলতা রয়েছে। ভাটার মালিক হাইকোর্টে মামলা করায় আদালত ছয় মাসের জন্য স্থিতাবস্থা জারি করেছেন। ফলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারিনি।

নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেহানা মজুমদার বলেন, “কামাল ব্রিকসের অনুমোদন নেই বলে শুনেছি। অবৈধ ভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।”

স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, অবিলম্বে অবৈধভাবে পরিচালিত ইটভাটাগুলো বন্ধ করতে হবে। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।