সাইকেলে ২৪৫ কিলোমিটার অভিযাত্রা কুবির তিন শিক্ষার্থীর
অন্যান্য সাধারণ দিনের মতো একটি নির্মল সকাল। কিশোরগঞ্জ সদরের নীলগঞ্জ ইউনিয়নের ভাসানীপুর গ্রামে সূর্য উঠেছিল প্রতিদিনের মতোই। কিন্তু সে সকাল ছিল তিন তরুণদের জন্য ব্যতিক্রম। দিলোয়ার হোসেন, আলি আকবর শুভ এবং মেহেদী হাসান রিফাত-তিন বন্ধু প্রস্তুত হচ্ছিলেন জীবনের এক বিশেষ অভিযানের জন্য। সাইকেল চালিয়ে পাড়ি দেবেন প্রায় ২৪৫ কিলোমিটারের দীর্ঘ পথ, গন্তব্য নেত্রকোনার পাহাড়ঘেরা জনপদ চন্দ্রডিঙ্গা।
তিনজনই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আগের ঈদে তারা এমন একটি সাইকেল অভিযানের স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু নানা ব্যস্ততায় তা বাস্তবায়ন হয়নি। এবারের ঈদে আসে সেই সুযোগ। পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলো-ভাসানীপুর থেকে শুরু করে নেত্রকোনার সীমান্তঘেঁষা পাহাড়, ঝর্ণা আর অজানা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে ছুটে চলা।
৩ জুন ভোর ৬টা, ব্যাকপ্যাকে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড়, পানির বোতল, হালকা খাবার ও একটি টুল কিট, আর সঙ্গে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে রওনা দেন তারা।
আরও পড়ুন: প্রথম দিনের গন্তব্য তবু মনটা বারবার টানছে—মা হয়তো এখনও পথে তাকিয়ে ভাবছে, ‘আমার ছেলে কবে আসবে’
প্রথম দিন ছিল, সিধলী ইউনিয়নের আতিথেয়তায় পরিপূর্ণ। প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে প্রথম দিন বিকেলে পৌঁছান নেত্রকোনার সিধলী ইউনিয়নে, যেখানে অপেক্ষায় ছিলেন তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রাকিবুল হাসান। ক্লান্ত শরীর, ধুলোমাখা সাইকেল, আর হৃদয়ে দিনভর উত্তেজনার গল্প নিয়ে তারা পৌঁছায় এক শান্তিপূর্ণ পরিবেশে।
রাকিবুলের মায়ের স্নেহভরা আতিথেয়তা ছিল, যেন হারিয়ে যাওয়া এক গ্রামীণ চিত্রকল্প। সামনের উঠোনে মরিচের ক্ষেত, পেছনে পুকুর, ঘিরে থাকা আম-জাম-কাঁঠালের গাছ। এদিন রাত ৪টা থেকে রান্না করা তার হাতে তৈরি ভর্তা-ভাজি-ডাল-ভাত সেই ক্লান্ত শরীরকে শুধু তৃপ্তই করেনি, মনে এক মায়ার ছোঁয়া দিয়ে গেছে।
দ্বিতীয় দিন ছিল, পাহাড় ছোঁয়ার আনন্দ। পরদিন ভোরে ঘুম ভেঙে আবার সাইকেলে চেপে যাত্রা শুরু। লক্ষ্য- পাঁচগাঁওয়ের চন্দ্রডিঙ্গা পাহাড়। গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছান ভারত সীমান্তসংলগ্ন এলাকায়, যেখানে সৌভাগ্যক্রমে বিজিবির কোনো কড়া ডিউটি না থাকায় তারা এক ঝর্ণার শাখা পর্যন্ত এগিয়ে যেতে সক্ষম হন।
শীতল জলের নিচে সাইকেল যাত্রার ধুলো ধুয়ে যেন তারা নতুন প্রাণ ফিরে পেলেন। পাহাড়ের পায়ের নিচে দাঁড়িয়ে সাইকেল পাশে রেখে তাকিয়ে ছিলেন সামনে বিস্তৃত সবুজে- প্রকৃতির এক অপার রহস্যে।
ফিরতি যাত্রা ছিল, ক্লান্তির কাছে হার না মানার দিন। দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যায় শুরু হয় ফেরার যাত্রা। পিঠ-কোমর তখন অবশ, পায়ে আর নেই শক্তি, তবুও থামেননি তারা। প্রতি ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটারে একবার বিশ্রাম, কারও সাইকেল চালাতে সমস্যা হলে, অন্যজন দেন ঠেলে। বন্ধুত্বের এমন ছবি রাস্তায় ছায়া হয়ে দিয়েছে ধরা।
রাত বাড়তে থাকে, রাস্তা ফাঁকা, শুধু সাইকেলের টায়ারের শব্দ আর ক্লান্ত শ্বাস। অবশেষে রাত ১১টায় তারা পৌঁছান নিজ গ্রাম ভাসানীপুরে- চোখে-মুখে বিজয়ের তৃপ্তি।
অভিযানের অভিজ্ঞতা ও অনুপ্রেরণা নিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী দিলোয়ার হোসেন বলেন, “এই অভিজ্ঞতা শুধু আমাদের ক্লান্ত করেনি, আমাদের বড় করেছে। নিজেদের ভেতরে যে শক্তি ছিল, সেটা আমরা খুঁজে পেয়েছি এই দুই দিনে।”
আরেক অভিযাত্রী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আলি আকবর শুভ যোগ করেন,“পথে শরীর অনেকবার বলেছে থেমে যেতে, কিন্তু বন্ধুরা হাত ধরেছে। বন্ধুত্বই আমাদের চালিয়ে নিয়ে গেছে।”
তৃতীয় অভিযাত্রী মেহেদী হাসান রিফাত বলেন, “এটা যাত্রা আমাদের জীবনে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছে, মনে সাহসের সঞ্চার করেছে।”