২১ মে ২০২৫, ১৮:৪৮

ষড়ঋতুর ছোঁয়ায় জীবন্ত এক ক্যাম্পাস

ষড়ঋতুতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়  © টিডিসি সম্পাদিত

বাংলার প্রকৃতি ছয় ঋতুর ছয় রঙে সাজে প্রতি বছর, আর এই রঙের ছোঁয়ায় প্রতিনিয়ত রূপ বদলায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয় যেন ঋতুর সঙ্গে একসাথে শ্বাস নেয়, গায় জীবনের গান। এখানে ঋতু মানেই শুধু আবহাওয়ার বদল নয়; বরং প্রতিটি ঋতুই বহন করে এক অনন্য অনুভূতি, সৌন্দর্য ও ছন্দ।

গ্রীষ্ম

ছায়ার আশ্রয় আর ফলের সুবাসে ভরা সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষদ সজ্জিত হয় তার আপন ছন্দে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে যখন সূর্য মাথার ওপরে রুদ্র রূপে হাজির হয়, তখন কুবির ছায়া ঘেরা পথগুলো হয়ে ওঠে প্রশান্তির নীড়। ক্যাম্পাসে প্রধান ফটকের সামনে ক্যাসিয়া জাভানিকার গোলাপি আভরণ দোলা যেন রঙিন ক্যাম্পাসে অভ্যর্থনা জানায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।

গোলমোহর ফুলের রক্তিম সৌন্দর্য বাঙালিদের হাজার বছরের ইতিহাসকে স্মরণে রাখে। পথে পথে পড়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া ফুলের প্রাকৃতিক লালগালিচা যেন রাজকীয় ভাব এনে দেয়। পাহাড়ি পাদদেশে তৈরি হওয়া ভবনগুলোর উপর থেকে পাখির চোখে দেখা ক্যাম্পাসে যেন লাল হলুদের রাজসিক ভাব ফুটে উঠে ক্যাম্পাসে। রাস্তার পাশ ধরে লাগানো কৃষ্ণচূড়া ও সোনালীর আভা মাতিয়ে রাখে দর্শনার্থীদের। ক্যাম্পাসে এসময় কাঁঠাল, তাল, আম নিয়ে চলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অঘোষিত ফলের উৎসব। সেন্ট্রাল ফিল্ডে চলে ক্রিকেটপ্রেমীদের উন্মাদনা, একে অপরের সাথে গড়ে তোলে হৃদ্যতার সম্পর্ক। গ্রীষ্মে ক্লান্ত প্রকৃতির মাঝেও কুবি ক্যাম্পাসে থাকে এক ধরনের ত্যাগের সৌন্দর্য, ফলদানকারী গাছগুলোর মতো।

বর্ষা

সবুজের বিস্তার আর বৃষ্টির নৃত্যে ক্যাম্পাস পরিণত হয় নাট্যশালায়। আষাঢ়-শ্রাবণের আগমনে ক্যাম্পাসে নামে বৃষ্টির রোমাঞ্চ। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামে ঝরনা ধারার মতো রিমিঝিম শব্দ, বৈশাখী চত্বরের বৃক্ষগুলো হয়ে উঠে উদ্যমী, আর কেন্দ্রীয় মাঠে খেলায় মেতে উঠে ফুটবলপ্রেমী শিক্ষার্থীরা। রাস্তার পাশের ঘাস হয়ে ওঠে চির সবুজে ভরা। জারুল গাছে ফোটে বেগুনি ফুল, আর লতারাজি খোঁজে নিজের ঠাঁই দেয়াল ধরে। ক্যাম্পাস, বিজয়-২৪, নজরুল হল, সুনীতি-শান্তি হল ও ফয়জুন্নেসা হলের সামনের টং দোকানে ধোঁয়া উঠা গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শিক্ষার্থীরা নিজেকে করে তোলে প্রাণবন্ত।

শরৎ

আকাশের নীল আর কাশফুলের শুভ্রতা নিয়ে শরৎ আসে তুলোর মতো মেঘের মৃদু ভেলায় চড়ে। ক্যাম্পাসজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে শান্ত, নির্মল এক সৌন্দর্য। গোলমোহর রোড, লাল বাসের স্ট্যান্ড ও কেন্দ্রীয় মাঠের পাদদেশে লালমাই পাহাড়ের পাশে মাথা দোলায় কাশফুলের সারি। এই জায়গাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পর্যটকদের একটি মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে পরিণত হয়। আইন ও ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে দেখা যায় নীল আকাশে ভাসমান সাদা মেঘের ভেলা। ঝরা পাতার অপেক্ষায় থাকা গাছগুলো আর স্বচ্ছ আলো মিলে গড়ে তোলে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।

হেমন্ত

সোনালি রোদ আর শস্যের গন্ধ কার্তিক-অগ্রহায়ণের হেমন্তে ক্যাম্পাস যেন হয়ে ওঠে নিঃশব্দ আলোয় মোড়ানো এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যে। পাশের গ্রাম থেকে ধানের গন্ধ ভেসে আসে, ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে শান্ত আর গম্ভীর। পাতা ঝরার শব্দে মুখর হয়ে থাকে মুক্তমঞ্চের গাছতলা। ক্যাম্পাসের চেনা পথগুলো পায় সোনালি ছোঁয়া, এক ধরনের ক্লান্ত, অথচ তৃপ্ত সৌন্দর্য।

শীত

কুয়াশার চাদর, ফুলের উষ্ণতা ও প্রকৃতির নির্দয় রিক্ততার চাদরে মুড়িয়ে রাখে কুবি ক্যাম্পাসের প্রতি ইঞ্চি। পৌষ-মাঘের ভোরে ক্যাম্পাসে নামে ধূসর কুয়াশার পরত। দূরের সূর্যের কিরণ আলো দেখায় ধোঁয়াটে, আর কচি ঘাসে জমে শিশির বিন্দু হয়ে উঠে একফালি সোনালি কিরণ। আব্দুল কাইয়ুম চত্বরে ফুটে ওঠে গাঁদা, জিনিয়া, ডালিয়ার সারি বেগুনি, হলুদ আর কমলার মিশেলে এক রঙিন স্বপ্নলোক। ক্যাসিয়া জাভানিকা, জারুল, সোনালু ও গোলমোহর গাছগুলো হয়ে ওঠে আরও শান্ত, যেন বসন্তের প্রস্তুতিতে নিঃশব্দে ধ্যানরত। সারাদিনের ক্লাস, সেমিস্টার, ল্যাবসহ নানা ব্যস্ততার পরেও কুয়াশা জড়ানো বিকেল বেলায় উষ্ণ কাপড় গায়ে জড়িয়ে টিউশনের জন্য বেরিয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। শহরগামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসগুলো উপচে পড়ে শিক্ষার্থীদের ভিড়। রাতের বেলায় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে চলে ব্যাডমিন্টনের প্রতিযোগিতা, যা শিক্ষার্থীদের মেলবন্ধন আরও দৃঢ় করে।

বসন্ত

রঙের বিস্ফোরণ ও প্রাণের উল্লাসে নেচে উঠে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মন। ফাল্গুন-চৈত্রে কুবি ক্যাম্পাসে আসে বসন্তের নবজাগরণ। গোলমোহর, শিমুল আর ডালিয়ায় ভরে ওঠে আগুনরঙা ফুলের সৌন্দর্যে। বাতাসে থাকে কোকিলের ডাক, গায়ে লাগে হালকা রৌদ্রের গরম আর ফুলের গন্ধে ভরপুর মৃদু বাতাস। ক্যাম্পাসের প্রতিটি কোণ যেন বলে ওঠে, এখানে জীবনের উল্লাস চলে ছন্দময়তায়। এসময় ক্যাম্পাসে উৎসবের আমেজে বরণ করে নেয়া হয় বসন্তকে। মুক্তমঞ্চ, নীল বাসের স্ট্যান্ড প্রতিটি জায়গায় থাকে বাহারি নকশাদার দোকান।

ষড়ঋতুর অনন্য সৌন্দর্যে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠে জীবনানন্দের ধূসর পাণ্ডুলিপি। প্রতিটি ঋতুই এখানে পাঠ দেয় জীবনের নতুন অধ্যায়, শেখায় ভালোবাসা, ধৈর্য আর অনন্ত সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করার শিল্প।