১৮ মার্চ ২০১৯, ২০:০১

মেয়েটার পরিস্থিতি কেউ বুঝলো না; তাকে বাঁচতে দিন: মায়ের আকুতি

হাসপাতালে শোয়া ওই ছাত্রী ও প্রতীকী মা  © ফাইল ফটো

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) মেয়েদের আবাসিক হলে সন্তান প্রসবের পর শিশুকে ট্রাঙ্কবদ্ধ করে রাখার ঘটনায় অনুতপ্ত বাবা-মা দু’শিক্ষার্থী। অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ক্ষুণ্ণ হওয়াতে জাবির এই যুগল সবাইকে মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে ব্যাপারটি দেখার আহ্বান জানিয়েছেন। সোমবার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে আলাপকালে ওই ছাত্রী, তার মা ও রনি মোল্লা জানিয়েছেন, অনেক কারণেই তাকে ওই অবস্থায় সন্তান প্রসব করতে হয়েছে। একদিকে ফাইনাল পরীক্ষা চলায় হলেই থাকতে হচ্ছিল; অন্যদিকে যেহেতু গোপনে বিয়ে হয়েছে, তাই সামাজিকতার কারণে প্রেগনেন্সির বিষয়টিও কাউকে বলা যাচ্ছিল না। সেই সঙ্গে অনাগত ও পরে সদ্যজাত সন্তানকে বাঁচানোর অক্লান্ত চেষ্টা- সবমিলিয়ে পরিস্থিতিই তাকে ওই পর্যায়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। যদিও সেই সমাজের জালেই আটকে পড়ে নানা ধরণের অপবাদের শিকার হচ্ছেন তারা।

শনিবার গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন মহলে তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করে দশ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

জানা যায়, সন্তান জন্ম দেয়া ওই ছাত্রীর ‘স্বামী’ রনি মোল্লা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩তম ব্যাচের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী এবং তিন শহীদ সালাম বরকত হলের আবাসিক ছাত্র। তাদের উভয়ের বাড়িও পাবনা জেলায়। দু'জনই পাবনার শহীদ সরকারি বুলবুল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে জাবিতে ভর্তি হয়েছে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে আলাপকালে রনি বলেন, আমাদের সামান্য ভুল বোঝাবুঝি ও যোগাযোগে ঘাটতি এবং সময়ের আগেই সন্তান প্রসবের জন্য তাকে আমরা বাড়িতে নিতে পারিনি। আবার এর মাঝে তার ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। এরই মধ্যে সন্তান প্রসব হওয়ায় সে ভয় পেয়ে ভুল করে বসে। যা মোটেই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। আমি পুরো ঘটনার জন্য অনুতপ্ত। আশা করি, তদন্ত কমিটি মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে ব্যাপারটি দেখবেন।

আর সন্তান প্রসবকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ওই ছাত্রী বলেন, পাবনার শহীদ বুলবুল কলেজ পড়ার সময়েই আমাদের মাঝে সম্পর্ক ছিল। এরপরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরে আম্মুকে জানিয়ে ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল আমরা বিয়ে করি। তিনি জানান, মৃত্যুর সনদে নবজাতকটির ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হয়েছে বলে উল্লেখিত হয়েছে। ছাত্রীর বাবা স্বাক্ষর করে নবজাতকের মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির উপস্থিতিতে গ্রহণ করেছেন। সুতরাং সন্তানের মারা যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যার সুযোগ নেই।

বিয়ের বিষয়টি স্বীকার করে ছাত্রীর মা-ও বলেন, ‘আমার মেয়ে বাচ্চাটিকে মেরে ফেলতে চায়নি। সে ভয়ের মধ্যে ছিল। কী করতে হবে, বুঝতে পারেনি। অথচ পুরো ঘটনা না জেনেই সবাই তাদের অপবাদ দিচ্ছেন। আশা করি সবাই তা বুঝবে। এখন সে অনেক বেশি অনুতপ্ত এবং সবসময়ই কান্নাকাটি করছে। এ সময় অপবাদ বন্ধ করে মেয়েকে বাঁচানোর সবার সহযোগিতা চান তিনি।’

সন্তান প্রসবের ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসের মাধ্যমে ওই ছাত্রীর সঙ্গে তার প্রেমের কথা অস্বীকার করে ইতোমধ্যেই সন্তানের পিতৃত্বের কথা জানিয়েছেন রনি মোল্লা। তিনি নিজেদের ‘বিবাহিত’ উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘আমার সঙ্গে ওই ছাত্রীর প্রেমের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ওই সন্তানের বাবা আমি। বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ঘটেছে। এ নিয়ে কেউ বাজে মন্তব্য করবেন না।’

অন্যদিকে পুরো ঘটনা তদন্তে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের আবাসিক শিক্ষিকা রাবেয়া খাতুনকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমরা তদন্তের কাজ করছি। এরই মাঝে আমরা বেশ কিছু কাজ এগিয়ে নিয়েছি, এখনই সবকিছু বলা যাচ্ছে না।

বিয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা প্রমাণ সাপেক্ষ ব্যাপার, তদন্ত শেষ হলেই তা প্রমাণ হবে। হলে বাচ্চা প্রসবের নিয়ম আছে কি-না এমন প্রশ্নের ব্যাপারে তিনি বলেন, সেটা ইমার্জেন্সি ছিল কি-না তা জানতে হবে, সাধারণভাবে হলে বাচ্চা প্রসবের ব্যাপারে কোন বৈধ নিয়ম নেই।

এর আগে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মুজিবর রহমান বলেন, ছাত্রীদের তথ্যের ভিত্তিতে ঘটনাটি জানা মাত্র হলে যাই। কান্নার শব্দ শুনে সঙ্গে সঙ্গে ট্রাংকের তালা ভেঙে নবজাতককে উদ্ধার করি ও পরে তাকে মেডিকেলে নিয়ে যাই। কিন্তু বাচ্চাটিকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নবজাতকের মৃত্যু হয়।

প্রভোস্ট আরও বলেন, ‘হল সুপার এবং ওই রুমের শিক্ষার্থী আমাকে বলেছে, মেয়েটির স্বাস্থ্য একটু ভালো এবং সে সব সময় সোয়েটার ও চাদর পরে থাকতো। যার কারণে কখনো বোঝা সম্ভব হয়নি যে, তার গর্ভে বাচ্চা রয়েছে।’ ইতোমধ্যে এই ঘটনায় আবাসিক শিক্ষক রাবেয়া খাতুনের নেতৃত্বে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান তিনি। আর তদন্ত কমিটিকে দশ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতেও বলা হয়েছে।