অবহেলিত জনপদে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা
লালমনিরহাট সদর উপজেলার একটি দারিদ্র্যপীড়িত এবং অবহেলিত ইউনিয়ন কুলাঘাট। নদী ভাঙ্গনসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত ইউনিয়নটি আগে থেকেই শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে। তবে সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে শিক্ষা আলো ছড়াতে এগিয়ে এসেছেন বেশকিছু বিশ্বিবিদ্যালয় পড়ুয়া তরুন শিক্ষার্থী। এলাকার শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়নের জন্য কুলাঘাট থেকে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত কিছু স্বপ্নবাজ তরুণ মিলে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ক্যাম্পাস’ নাসে একটি শিক্ষা উন্নয়নমূলক সংগঠন।
এক সময় ওই অঞ্চল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া দুস্কর হলেও এখন সে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে অনেক। বর্তমানে শুধুমাত্র কুলাঘাট ইউনিয়নেই রয়েছেন ৬৩ জন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ। এরমধ্যে ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বিবিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্বিবিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্বিবিদ্যালয় (বাকৃবি), রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্বিবিদ্যালয় (রুয়েট), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্বিবিদ্যালয় (কুয়েট), ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্বিবিদ্যালয়সহ (ডুয়েট) প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই রয়েছেন।
২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন এসব স্বপ্নবাজ তরুণরা। অর্থের অভাবে কোন ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষাগ্রহণ হুমকির মুখে পড়লেই এগিয়ে আসেন তারা। নিজেরা নানাভাবে সহায়তা করার পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের কাছেও তাদেরকে সহায়তা করার অনুরোধ করেন। তাদের প্রচেষ্টাতেই গত বছর কুলাঘাট ইউনিয়ন থেকে মোট আট জন ছাত্র-ছাত্রী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। প্রতি বছরই এভাবে স্থানীয় ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়তা করছেন ‘ক্যাম্পাস’র তরুণরা।
জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকার অনুদান নিয়ে চুমকি আক্তারকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) ভর্তি করার ব্যবস্থা করেছে সংগঠনটি। ইতিহাস বিভাগে অধ্যয়নরত চুমকি আক্তার বলেন, ‘টাকার অভাবে আমার বিশ্বিবিদ্যালয়ে ভর্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। সেসময় ‘ক্যাম্পাস’র ভাইয়েরা ডিসি স্যারের নিকট থেকে টাকা ম্যানেজ করে দিলে বেরোবিতে ভর্তি হই।’
তিনি বলেন, এলাকার শিক্ষার্থীদের যেকোন সমস্যা সমাধানে কাজ করে যাচ্ছে ক্যাম্পাস। স্থানীয় অনেকেই তাদেরকে সহযোগিতাও করছে। কুলাঘাট থেকে যেন অধিক সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় সেজন্য সকল ধরনের তথ্য সরবরাহ, দিক-নির্দেশনাসহ অভিভাবকদের সচেতন করার সব কাজই করেছে সংগঠনটি।
শুধু এতেই থেমে থাকেননি এসব স্বপ্নবাজ তরুণরা। তারা ইউনিয়নের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে নিয়মিত সভা, সেমিনার ও বার্ষিক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা গ্রহণ ও পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করছেন। বিশ্বিবিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময় কুলাঘাটের ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা করাসহ অন্যান্য তথ্য সরবরাহ করছেন। ভর্তির পরে কারোর পড়াশুনায় ব্যঘাত ঘটলে আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। এছাড়া প্রতিবছর অনুষ্ঠান করে জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসিতে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী ও গুণীজনদের সংবর্ধনা দেওয়ারও আয়োজন করছেন তারা।
ক্যাম্পাস’র সাথে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এসব অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছেন সাবেক জেলা প্রশাসক মোঃ হাবিবুর রহমান, আবুল ফয়েজ মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ফকির, সরকারি কর্ম-কমিশনের (পিএসসি) সদস্য অধ্যাপক মো. হামিদুল হক, বর্তমান জেলা প্রশাসন মো. শফিউল আরিফ, এডিশনাল এসপি সুশান্ত সরকার প্রমুখ। তারা এসব স্বপ্নবাজ তরুণদের কর্মকাণ্ডের প্রশংসাও করেছেন।
ক্যাম্পাস‘র দেওয়া তথ্য অনুযায়ি, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থীর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা গ্রহণ করেছে সংগঠনটি। এরমধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারী ৭৫ জনকে পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসিতে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ৮৫ জনকে সংবর্ধনা ও ক্রেস্ট প্রদান করেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া ২০ জনকেও সংবর্ধনা ও ক্রেস্ট প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, চাকুরীজীবীসহ মোট ১৬ জন গুণব্যক্তিকে সংবর্ধনা ও ক্রেস্ট প্রদান করেছেন তারা।
সম্প্রতি নদীভাঙ্গনে সব হারানো সুমি নামের এক ছাত্রীর টাকার অভাবে কলেজে ভর্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তাকে কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করেছেন ক্যাম্পাস’র তরুণরা। ২০১৮ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া শাহ-আলমকে নিয়ে গণমাধ্যমে নিউজ প্রকাশের ব্যবস্থা করে তারা। ফলে সে একটি বেসরকারি ব্যাংকের সহায়তায় এখন উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করছে।
এ বিষয়ে শাহ আলম বলেন, ‘পরীক্ষার আগেই মাকে হারিয়েছি। এছাড়া আরও নানা কারণে আমাদের পরিবার বেশ খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো। এখবর শুনে ক্যাম্পাস’র ভাইয়ের আমার পাশে দাড়িয়েছে।’ তিনি বলেন, এলাকার শিক্ষা বিস্তারে তারা অনেক ভালো কাজ করছে। এলাকার মানুষও তাদের পাশে আছে।
নিজেদের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ক্যাম্পাস’র সভাপতি ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ছাত্র মোঃ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘কুলাঘাটকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের আঁতুড়ঘর হিসেবে গড়ে তুলে লালমনিরহাটে একটি মডেল ইউনিয়ন হিসেবে পরিচিত করানোই আমাদের মূল লক্ষ্য। ২০২২ সালের মধ্যে এর সদস্য সংখ্যা ৬৩ থেকে ১০০ পূরণ করার লক্ষ্যে যাবতীয় পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, উপজেলা সমাজসেবা অফিসে তাদের সংগঠনের নিবন্ধনের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এটি হয়ে গেলে এর কার্যক্রম আরো বেগবান হবে। এজন্য সমাজের সবার সহযোগিতাও কামনা করেছেন তিনি।