০২ জানুয়ারি ২০১৯, ১৬:০৯

বছরজুড়ে আলোচনায় ‘হাতুড়ির নিচে জীবন’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

বিদায় ২০১৮। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আন্দোলনকারীদের উপর ছাত্রলীগের হামলা, বিশেষত মামুনের দানবীয়তা, এক্সরে রিপোর্টে তরিকুলের টুকরো হয়ে যাওয়া পায়ের, ক্ষতিগ্রস্ত মেরুদণ্ড এবং দুই বিভাগকে একীভূত করা নিয়ে আন্দোলনসহ বিদায়ের এ বছরজুড়ে নানা ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)।

কোটা সংস্কার আন্দোলন: এরশাদের সামরিক নিপীড়নের কালে কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন ‘হাতুড়ির নিচে জীবন’। মাত্র তিন শব্দের বাক্য দিয়ে কবি যা বুঝিয়েছেন, লক্ষ শব্দ লিখেও তা বোঝানো কঠিন। সবচেয়ে বড় কথা কবিতার প্রাসঙ্গিকতা। বছরেরর মাঝামাঝি সময়ে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সেই চিত্রই ফুটে উঠেছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রকাশ্যে রামদা, লোহার রড, হাতুড়ি ও বাঁশের লাঠি নিয়ে আন্দোলনকারীদের ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের পর আলোচনায় আসে দেশের উত্তরাঞ্চলের বিদ্যাপিঠটি। ২ জুলাই বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের কাছে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে এ হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় গুরুত্বর আহত হন কোটা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ রাবি শাখার অন্যতম নেতা তরিকুল ইসলাম তারেক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। রাবি ছাত্রলীগের ১০-১৫ জন নেতাকর্মী এ হামলায় মূল ভূমিকা পালন করেন। তবে ওই হামলাকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি যিনি আলোচনায় আসেন, তিনি হলেন রাবি ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক আবদুল্লাহ-আল-মামুন।

হাতুরি নিয়ে ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক আবদুল্লাহ-আল-মামুন।

হামলার ছবি ও ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে তরিকুলকে যখন বাঁশের লাঠি দিয়ে পেটানো হচ্ছিন, তখন তিনি নিথর শুয়ে থাকেন। এরই মধ্যে হলুদ গেঞ্জি পড়া একটি ছেলে তার কোমর এবং পায়ে হাতুরি সদৃশ একটি বস্তু দিয়ে পেটাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক আবদুল্লাহ-আল-মামুনই সেই ব্যক্তি যিনি হাতুড়ির মতো দেখতে বস্তুটি নিয়ে এসেছিলেন। ওই হামলার পর আহত তরিকুলকে রাজশাহী সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা হয়নি। তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন তরিকুলের ভাই-বোন-বন্ধুরা।

দেশব্যাপী আলোড়ন তোলা ওই হামলার পর কেটে গেছে ৬ মাসেরও বেশি সময়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তরিকুল ইসলামকে যারা পিটিয়েছেন, মামুনসহ অন্যদের পরিচয়ও পাওয়া গেছে। তারা সবাই ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পদধারী নেতা। তবে পুলিশ এখনও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযোগ করলে সক্রিয় হবে তারা। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, হামলাকারীদের শনাক্তের চেষ্টা করছেন তারা।

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন

 

দশম সমাবর্তন: সমাবর্তন অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি সেই ২০১৬ সাল থেকেই। বার বার তারিখ পরিবর্তনের পর এবছরের ২৯ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত হয় দশম সমাবর্তনের দিন। দেশের দূরদূরন্ত থেকে শিক্ষার্থীদের আগমণে শুক্রবার কাণায় কাণায় পূর্ণ হয় পুরো ক্যাম্পাস। সাবেক ও বর্তমানদের অংশগ্রহণে সৃষ্টি হয় মিলনমেলার। এ সমাবর্তনে ডিগ্রির স্বীকৃতি পেয়েছেন নিবন্ধিত ৬ হাজার ১৪ জন শিক্ষার্থী। ২০১১ থেকে ২০১৪ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত স্নাতকোত্তর , এমফিল, পিএইচডি, এমবিবিএস, বিডিএস ও ডিভিএম এই ৬টি পর্যায়ে তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন তাঁরা।

রাবির দশম সমাবর্তন

 

প্রকাশ্যে থিসিস পেপার বিক্রি: আলোচনার মধ্যে ছিল গত কয়েক বছর ধরে ফটোকপির দোকানগুলোতে প্রকাশ্যে বিক্রি হওয়া পুরাতন থিসিস পেপার। ফটোকপির দোকানে সহজলভ্য হওয়ায় মাস্টার্স পর্যায়ে গবেষণা জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার উপর এর বিরুপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলেও দাবি করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ গবেষকগণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে পূর্বের গবেষণা পেপারের সহজলভ্যতাকেও দায়ি করেন অনেকে।

গবেষণার পুরাতন পেপার গুলো শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটোকপির দোকানগুলো থেকে জোগাড় করছেন। সর্বনিম্ন ৩শত টাকাতে বিক্রি হয় সফট কপি। চাহিদার সাথে গবেষণা পেপার মিলে গেলে টাকা বাড়তে থাকে। সেক্ষেত্রে ৫ শত টাকা বা আরও উচ্চ মূল্যে বিক্রি হয় এসব গবেষণাপত্র। এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে।

বিসিএসএর ফরম পূরণ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে দোকানীর প্রতারণা: বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ৪০তম প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফরম ভুলভাবে পূরণ করে শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত দোকানিদের পুলিশে সোপর্দ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ১৫ নভেম্বর সকালে প্রতারণার বিষয়টি সামনে আসার পর তাদের আটক করে প্রক্টর অফিসে দুপুর পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে বেলা ২টার দিকে তাদের মতিহার থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

দুই বিভাগ একিভূতকরণ আন্দোলন: বছর শেষে সবচেয়ে বেশি আলোচনার বিষয় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ ও ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ (এপিইই) ও ইলেক্ট্রিকাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগকে একীভূত করা নিয়ে দুইটি বিভাগের টানা তিনসপ্তাহ ব্যাপী অবস্থান, অনশন কর্মসূচীর পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুইটি বিভাগ একিভূত করে। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে ইইই বিভাগে একীভূত করা হয়।

দুই বিভাগ একত্রিকরণের দাবিতে আন্দোলন

 

সাংবাদিক মারধর : বছরের শেষ দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে বাণিজ্যিক সিনেমা প্রদর্শনীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনায় পেশাগত দায়িত্ব পালন কালে বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক আলী ইউনূস হৃদয়ের উপর হামলা করে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাবরুন জামিল সুষ্ময়। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।

মেগা প্রকল্পে মিডিয়া সেন্টার অন্তর্ভূক্তি: প্রস্তাবিত ৫০ বছর মেয়াদী ‘মাস্টার প্ল্যান’-এ মিডিয়া সেন্টার অন্তর্ভুক্তকরণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত এক মতবিনিময় সভায় সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়।