ফিরে দেখা ২০১৮
অর্জন আর উদ্ভাবনে র্যাঙ্কিংয়ে দেশসেরা চবি!
- এ এইচ আজহার, চবি
- প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০১৯, ১০:৪৯ AM , আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৯, ০১:৪৯ PM
বিদায় ২০১৮। বিদায়ের এ বছরজুড়ে নানা ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)।বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অর্জন আর উদ্ভাবনে চবি র্যাঙ্কিংয়ে দেশসেরা নির্বাচিত হয়। এবছর নানা দাবি আদায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমেছিল। বারবার পত্র-পত্রিকায় নেতিবাচক শিরোনাম হয়েছে ছাত্রলীগ। সব মিলিয়ে বিদায়ী এই বছরজুড়েই নানা আলোচনা-সমালোচনায় পত্র-পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)।
কোটা সংস্কার আন্দোলন: দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীদেরও কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছিলো স্বতঃস্ফূর্ত। প্রথমদিকে চবি ছাত্রলীগের সমর্থন দেখা গেলেও পরবর্তীতে বিপরীতমুখী অবস্থান নেয় তারা। ফলে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের তিক্ত অভিজ্ঞতারও অন্ত ছিলো না। যার ফলস্বরূপ ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা একাধিকবার ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলার স্বীকার হয়েছেন। কোটা সংস্কার সম্বলিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যক্তিগত মতামতের স্ক্রিনশট নিয়ে একাধিক শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনাও ঘটে। এদিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তির অভিযোগে কারাগারে যান চবির সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম। এ ঘটনায় তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার মামলায় গত ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে ৩৭ দিন কারাভোগ করেন তিনি। সাথে তিন দিনের রিমান্ডেও ছিলেন।
ছাত্রলীগের সাংবাদিক মারধর ও হত্যার হুমকি: শিক্ষার্থীকে র্যাগ দিতে বাধা দেওয়ায় আলোকিত বাংলাদেশের চবি প্রতিনিধি মিনহাজ তুহিনকে মারধর করে চবি শাখার ছাত্রলীগ কর্মীরা। এর কিছুদিন আগেই চবি সাংবাদিক সমিতির প্রচার, প্রকাশনা ও দপ্তর সম্পাদক জোবায়ের চৌধুরীকে জবাই করে হত্যার হুমকি দিয়েছিলো চবি ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সহসভাপতি রেজাউল হক রুবেল।
বছরজুড়ে ছাত্রলীগের মধ্যকার সংঘর্ষ অভ্যন্তরীণ কোন্দল থেকে ছাত্রলীগের একাধিক পক্ষের মধ্যে বছরের অধিকাংশ সময়েই সংঘর্ষ বেঁধে থাকতো। ফলে ক্যাম্পাসের পরিবেশ ছিলো অস্থিতিশীল। এছাড়াও চবি ছাত্রলীগের পাঁচ কর্মীর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন, সাংবাদিক মারধর, চুরিসহ একাধিক অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কৃত হয়েছিলো ছাত্রলীগের ১১ নেতা-কর্মী।
শিবির সন্দেহে শিক্ষার্থীদের মারধর: বছর জুড়েই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিবির সন্দেহে একাধিক শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনা ছিলো চোখে পড়ার মত। এমনকি ব্যক্তিগত কোন্দল থেকেও শিবির আখ্যায়িত করে চবির হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী ফয়েজুর রহমান সিয়ামকে একাধিকবার মারধর করে ছাত্রলীগকর্মী মিলন হাওলাদার। এছাড়া শিক্ষকতার জন্য আবেদন করতে আসা আজাদ হোসেন নামে চবির সাবেক এক শিক্ষার্থীকে শিবির আখ্যায়িত করে মারধর করা হয়।
খালেদা জিয়া হলের নাম উপড়ে ফেলা: প্রশাসনের নির্দেশ ব্যতিরেকেই গত ৪ ডিসেম্বর চবির ছাত্রীদের আবাসিক হল ‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হল’র নামফলক উপড়ে ফেলে চবি শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। চবি সাদা দলের শিক্ষকদের দাবি- বিষয়টি সম্পূর্ণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল হলেও গায়ের জোরে এমনটা করেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা: এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনা ছিলো অন্যতম। বছরের শেষ দিকে এসে ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে চবির অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থবর্ষের শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীর রাজু আত্মহত্যা করে সেই তালিকায় চবির নামটিও লিখে গেছেন।
রবিউলের ট্রেনে কাটা পড়া: গত ৮ আগস্ট শাটল ট্রেনে কাটা পড়ে দুই পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় চট্টগ্রাম চবির সমাজতত্ত্ব বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী রবিউল আলমের। স্বপ্ন ছুঁই ছুঁই রবিউলের স্বপ্ন ভঙ্গের দৃশ্য সহপাঠীদের চোখে দেখা।
শাটল ট্রেন সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন: শাটল ট্রেনের বগি বৃদ্ধি, ট্রেনের সংস্কার, রবিউলের ক্ষতিপূরণ, রাতের ট্রেনে নিরাপত্তা জোরদারসহ সাত দফা দাবিতে রবিউলের সহপাঠীরা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেন। ফলস্বরূপ ট্রেনের দুটো বগি সংযোজন করা হয়।
র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম স্থান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়কে পিছনে ফেলে ওয়েবসাইট ভিজিট জরিপে বাংলাদেশের ১৪৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে উঠে আসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ৩০৫০তম স্থানে ছিলো চবি। যেখানে ঢাবির আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংছিলো ৫০২৫তম। ওয়েবোমেট্রিক্স নামে একটি সংস্থা তাদের এক জরিপে এই র্যাংকিং প্রকাশ করেন।
ভর্তি জালিয়াতি রোধ: প্রশ্নফাঁস বন্ধ এবং ভর্তি জালিয়াতি রোধে চবি প্রশাসনের ভূমিকা ছিলো চোখে পড়ার মত। সুষ্ঠু ভর্তি নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই সকল পরীক্ষার ব্যবস্থা, সিইউ এন্টি প্রোক্সি অ্যাপস তৈরী, নিরাপত্তা জোরদার, ‘প্রক্সিডন’ আনোয়ার হোসেনকে গ্রেফতারসহ একাধিক প্রোক্সিদাতাকে হাতেনাতে ধরে নিজেদের ভর্তি কার্যক্রমের সুষ্ঠুতা প্রমাণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
চবির প্রথম ভাস্কর্য ‘জয় বাংলা’র উদ্বোধন: ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২ বছরের ইতিহাসে কমতির মধ্যে অন্যতম ছিলো ভাস্কর্য। চলতি বছরের ২৫ অক্টোবর সোহরাব জাহানের নির্মিত ‘জয় বাংলা’ ভাস্কর্য উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে চবির ইতিহাসের এই অধ্যায়টির সমাপ্তি ঘটে। যার সাক্ষী হয়ে থাকবে ২০১৮ সাল।
শাটল ট্রেন চলচ্চিত্র: চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকেই চবির ঐতিহ্য শাটল ট্রেনকে ঘিরে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়। যা শিক্ষার্থীদের মনে নতুন আনন্দের উদ্ভাবন করে। ডিসেম্বরের মধ্যেই ‘শাটল ট্রেন’ চলচ্চিত্রটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা। ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মুক্তি দেবার পরিকল্পনা রয়েছে চলচ্চিত্রটি। যা বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনার সাক্ষী।
চবি শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবন এবং অর্জন: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং তার সহযোগীদের ‘অ্যাডমিশন অ্যাসিস্ট্যান্ট’ অ্যাপস তৈরী। যা উচ্চ মাধ্যমিক শেষে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কলেজে ভর্তির ভোগান্তি দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
টিউশন মিডিয়ার বিপরীতে বিডি হোম টিউটর অ্যাপস তৈরী করে সাড়া জাগিয়েছিলেন চবির একাউন্টিং বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের দুই শিক্ষার্থী মো. মঞ্জুর আলম এবং মজিবুর রহমান সিজান। চলতি বছরের ২৪ অক্টোবর থেকে চালু করা হয় অ্যাপসটি।
তাছাড়া সহজে বাসা খুঁজে নিতে চবি শিক্ষার্থী আরফিন হায়াতের ‘হাউস-লেট’ ওয়েবসাইট তৈরী।জাতীয় জীবপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিযোগিতায় চবি শিক্ষার্থীদের প্রথম স্থান অর্জন। ২৬ নভেম্বর চবি উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারের সাহিত্যে ‘দীণেশচন্দ্র সেন স্মৃতি স্বর্ণপদক’ লাভ।
কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা:
পরীক্ষার উত্তরপত্র উধাও ও পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা: ১৬ মে মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের তিন সেমিস্টার পরীক্ষার বিপরীতে নয়টি কোর্সের প্রায় ৬০০ উত্তরপত্রের কিছু পুড়িয়ে ফেলা আর উধাও হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
উপাচার্যকে প্রাণনাশের হুমকি: ১৬ আগস্ট সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে আন্তর্জাতিক কোডযুক্ত (+৯১৯৮৭৪৯৭৮৯৪৬) একটি নম্বর থেকে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি মুঠোফোনে চবি উপাচার্যকে গালাগাল ও প্রাণনাশের হুমকির ঘটনা।
ভর্তিচ্ছু রহমতুল্লাহর অনশন: সনদপত্র খুইয়ে ভর্তি হতে না পারা রহমতুল্লাহর গত ২২ নভেম্বর আমরণ অনশনের পথ বেছে নেওয়ার ঘটনা টনক নেড়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিয়ম শিথিলতায় রহমতুল্লাহর অনশনও সফল হয়।