যে ফুল ফুটিবার আগেই ঝরে গেল
দুপুরে খাওয়ার পর ছাদে খেলতে গিয়েছিল ছয় বছর বয়সী রিয়া গোপ। ছাদে ওঠার কিছুক্ষণ পরেই বাসার সামনের রাস্তায় সংঘর্ষ বাধে। রাস্তার চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে বাবা ছুটে যান ছাদ থেকে মেয়েকে ঘরে আনতে। কিন্তু মেয়েকে কোলে নিতেই হঠাৎ একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় রিয়ার মাথায়। মুহূর্তেই ছোট্ট দেহটি নিথর হয়ে ঢলে পড়ে বাবার কোলে। আদরের সন্তানকে হারিয়ে তখন পাগলপ্রায় বাবা-মা।
চার বছর বয়সী শিশু আবদুল আহাদ। এখনো স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি সে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে বাসার নিচে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ দেখতে বারান্দায় বাবা-মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল আহাদ। আচমকা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে সে। প্রথমে বাবা-মা ভেবেছিল আহাদ হয়তো ভয় পেয়ে লুটিয়ে পড়েছে। কিন্তু রক্তে ভিজে ওঠে তার মুখমণ্ডল, তখন আর্তচিৎকারে কেঁপে ওঠে চারপাশ। আহাদকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। কারণ? বারান্দায় দাঁড়ানো আহাদের ডান চোখে লেগেছিল গুলি।
গত ১৯ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে মিরপুর কাফরুল থানার সামনের সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া ঢুকছিল সামিরের ঘরে। গ্যাসের ধোঁয়া যেন বাসায় ঢুকতে না পারে, সে জন্য জানালা বন্ধ করতে গেলে বাইরে থেকে হঠাৎ একটা গুলি এসে সামিরের চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। পরে তাকে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
তিনটি গল্প ভিন্ন রকম শোনা গেলেও পরিস্থিতি একই। তিনজনই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিশু শহীদ। তবে শুধু আহাদ, রিয়া বা সামির নয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলি ও সহিংসতায় সারা দেশে অন্তত ৬৭ জন শিশু-কিশোর নিহত হয়েছে; যাদের কোমলমতি পাগুলো আর কখনো পড়বে না নতুন বাংলাদেশের মাটিতে।
নিহত ৫৭ শিশুর মরদেহে গুলির চিহ্ন ছিল। এ ছাড়া দগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় ৯ কিশোরের। একজনের মৃত্যু হয়েছে সাউন্ড গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে।
তাদের জীবনপ্রদীপ নিভে গেলেও মানুষের হৃদয়ে তাদের অমর করে রাখতে রং-তুলির মাধ্যমে চব্বিশের গণআন্দোলনে শহীদ ৬৭ জন শিশুর নামের তালিকা সংবলিত গ্রাফিতি করেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘কাম ফর রোড চাইল্ড’ (সিআরসি)। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসির করিডোরের দেয়ালে একটি গাছ অঙ্কিত এই গ্রাফিতির স্লোগান, ‘যে ফুল ফুটিবার আগেই ঝরে গেলো’। গাছটির প্রতিটি পাতায় লেখা হয়েছে ৬৭ জন শিশু-কিশোরের নাম; যা তাদের স্মৃতি বহন করছে।
সিআরসির সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জীবনের অর্থ বোঝার আগেই যারা শাহাদত বরণ করেছে, তাদের চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য এবং ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করার জন্য কাম ফর রোড চাইল্ড (সিআরসি) ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সামান্য এই প্রয়াস।
তিনি বলেন, দেশের ইতিহাসে এটি ন্যক্কারজনক ঘটনা। প্রতিটি শিশুকেই স্মরণে রাখার জন্য আমরা এই ফুলগুলোর গ্রাফিতি অঙ্কনের উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা বিশ্বাস করি, এই শিশু শহীদদের আত্মত্যাগ আমাদের দেশপ্রেম উজ্জীবিত করবে।