পরীক্ষায় চান্স না পেয়েও তিন লাখ টাকায় ভর্তি মেরিটাইম ইউনিভার্সিটিতে!

মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির লোগো
মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির লোগো  © সংগৃহীত

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের ৩৭তম সরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সমুদ্রে অবস্থিত বিভিন্ন ধরনের সম্পদ আহরণের উপর উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরি করে দিতে। বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে অস্থায়ী রয়েছে ঢাকার মিরপুরের পল্লবীতে। উচ্চশিক্ষালয়টির স্নাতকে শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতিও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ভর্তি পরীক্ষার মেধা কিংবা অপেক্ষমাণ তালিকায় না থেকেও মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে একাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়েছেন দায়িত্বরত কর্মচারী ও কর্মকর্তারা। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।

অনুসন্ধান বলছে, গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) ১ম বর্ষ ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরপর ভর্তি প্রক্রিয়া শেষে গত ১০ মার্চ ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষের ওরিয়েন্টেশনের কিট তালিকা ও ক্লাস অ্যাটেনডেন্স শিট প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা দেখা যায়, বিবিএ ও এলএলবি প্রোগ্রামে এমন কয়েকজন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন, যারা প্রকাশিত মেধা তালিকা বা ওয়েটিং লিস্টে ছিলেন না। 

এতে প্রশ্ন ওঠে—আসন খালি থাকা সত্ত্বেও ওয়েটিং লিস্টে থাকা শিক্ষার্থীদের না ডেকে অন্য শিক্ষার্থীরা কীভাবে ভর্তি হলেন? এ প্রসঙ্গে সেসময়ে ওয়েটিং লিস্টে থাকা ভর্তিচ্ছু একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়টির ভর্তি সংক্রান্ত ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করলে এ বিষয়ে আলোচনা সমালোচনা হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই শিক্ষার্থী জানান, ‘এতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে কথা বলার সাহস পাইনি।

তবে এই ঘটনার পরেও একাধিক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করলে সহকারী রেজিস্ট্রার ইখতিয়ারুল ইসলাম তাদের জানান, তোমাদের ভর্তির সিরিয়াল আসলে জানানো হবে। কিন্তু ওয়েটিং লিস্টে থাকা ঐ ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা প্রায় এক মাস পরে ভর্তির জন্য ডাকা পায়।’ এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝেও দীর্ঘদিন ধরে ভর্তি প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির গুঞ্জন উঠে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক ভর্তিতে মেধা তালিকা থেকে ভর্তির পর অন্য বছরের ন্যায় পর্যায়ক্রমে ওয়েটিং লিস্ট প্রকাশ করা হয়নি। চলতি শিক্ষাবর্ষে মেরিটাইম গভর্নেন্স অ্যান্ড পলিসি (এলএলবি প্রোগ্রাম) এবং শিপিং অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ফ্যাকাল্টি (বিবিএ প্রোগ্রাম) ভর্তি কার্যক্রমে প্রথমে ৪০ জনের মেধা তালিকা এবং পরে ৬০ জন করে অপেক্ষমাণ তালিকা প্রকাশ করা হয়। 

মেধা তালিকা থেকে সরাসরি ভর্তি করা হলেও ওয়েটিং লিস্টের শিক্ষার্থীদের সিট ফাঁকা থাকা সাপেক্ষে ভর্তি নেয়া হয় এবং সিট না পাওয়া শিক্ষার্থীদের এডমিট কার্ড জমা দিতে বলা হয় ও কল করলে সিট ফাঁকা নেই জানানো হয়। ভর্তিচ্ছুদের অভিযোগ, পরবর্তীতে সিট ফাঁকা হলেও তাদের ভর্তি প্রক্রিয়ায় সময়মতো ডাকা হয়নি ।

এ ঘটনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ছিলেন রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ মুসা। গত ৫ আগস্টের পট-পরিবর্তনের পর সেপ্টেম্বরে তাকে সরিয়ে রিয়ার অ্যাডমিরাল আশরাফুল হক চৌধুরীকে নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার।

২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি সংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্বরত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার মো. ইখতিয়ারুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘নিয়ম অনুযায়ী ওয়েটিং লিস্টে থেকে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়েছে। সিট ফিল-আপ না হওয়ায় মে মাসে মেসেজ করে ওয়েটিং লিস্ট থেকে অপ্রকাশিত তালিকার শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো হয়েছে।’ কিন্তু ওয়েটিয় লিস্টে থাকা শিক্ষার্থীদের আগে অন্য শিক্ষার্থীরা কীভাবে ভর্তি হলেন জানতে চাইলে কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর দিতে পারেননি তিনি। 

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কমোডর মো. মনির উদ্দিন মল্লিক জানান, ‘ওয়েটিং লিস্টে থাকা শিক্ষার্থীদের কল করা হয়েছিল তারা রেসপন্স করেনি। তবে একাধিক ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা জানায় তারা কোনো ধরনের কল পায়নি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করে জানতে পারে সিট ফাঁকা নেই। কিন্তু এর মাঝেও ওয়েটিং লিস্টর বাইরে থেকে ভর্তি কার্যক্রম চলছিল বলে দাবি তাদের।

২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় দায়িত্বরত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ক্যাপ্টেন সাদ ইমন ইশতিয়াকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ওয়েটিং লিস্টের বাইরের শিক্ষার্থীদের নাম ও রোল জানতে চান। পরে তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন। 
তবে পরবর্তীতে তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি সন্দেহজনক শিক্ষার্থীদের মেধা তালিকার পজিশন একটি সাদা কাগজে লিখে নিয়ে এসে দেখান। কিন্তু ওয়েটিং লিস্ট দেখতে চাইলে তিনি দেখাতে অস্বীকৃতি জানান। ওয়েটিং লিস্টের বাইরের শিক্ষার্থীদের আগেই ভর্তির বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করলেও তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি। 

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ক্যাপ্টেন সাদ ইমন ইশতিয়াকের কাছেই ওয়েটিং লিস্ট ছিল। তাই ওয়েটিং লিস্ট প্রকাশ না করে এক ব্যক্তির কাছে সংরক্ষিত থাকায় ভর্তিতে অনিয়মের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়।

এর আগে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষেও মোটা অঙ্কের অর্থ বিনিময়ে একাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন এমন একজনের খোজ পায় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। এই শিক্ষার্থী জানান, ‘মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির ভর্তিতে ব্যাপক আর্থিক লেনদেন হয়। অনৈতিকভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি করা সেই চক্রের সাথে জড়িত আছেন উচ্চ পদস্থ অনেক কর্মকর্তা। এরমধ্যে রয়েছেন, ভর্তি সংক্রান্ত সহকারী রেজিস্ট্রার মো. ইখতিয়ারুল ইসলাম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের ব্যক্তিগত সহকারী মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক কর্মকর্তা জানান, ‘এই চক্রের সাথে সংস্থাপন শাখার আরিফ, নুরুল ও ইখতিয়ারুল ইসলামের ব্যক্তিগত সহকারী সোহেল শিকদার জড়িত আছেন।’

চক্রের সাহায্য নিয়ে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন সেশনে অন্তত ৪ জন শিক্ষার্থী ভর্তি আছেন বলে নিশ্চিত হয়েছে দ্যা ডেইলি ক্যম্পাস। ভর্তি হতে যারা ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করে দিয়েছেন। এরমধ্যে বিবিএতে সবচেয়ে বেশি টাকা নেয়া হয়, এরপর এলএলবিতে। অন্যান্য প্রোগ্রামেও নেয়া হয়, তবে তুলনামূলক কম। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ৪ জনের মধ্যে তিনজনের সরাসরি ও একজনের ব্যাংক মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসিপসনিস্ট (কর্মচারী) মুক্তা আক্তার অর্থ লেনদেনে সমন্বয় করেন। বর্তমানে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, ওয়েটিং লিস্টেরও একাধিক শিক্ষার্থী এই চক্রের মাধ্যমে ভর্তি হয়েছেন। শুধু এলএলবি ও বিবিএতেই এমন অনিয়মের সংখ্যা প্রায় ১০ জনে বেশি। এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য রিয়ার অ্যাডমিরাল আশরাফুল হক চৌধুরীর কাছে লিখিতভাবে বক্তব্য জানতে চেয়ে ২ সপ্তাহ অপেক্ষা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের নির্দেশে গত ৩ ডিসেম্বর প্রক্টর কমান্ডার মোহাম্মদ ইরফান মাহদী ও অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার কমান্ডার ফরহাদ হোসেনকে প্রাথমিক অনুসন্ধান করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তারা প্রতিবেদকের কাছে সবকিছু শোনেন এবং পরে অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার কমান্ডার ফরহাদ হোসেন প্রায় দুই সপ্তাহ পরে জানান, ‘শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে পরবর্তীতে একটি বোর্ড গঠন করা হবে বলেও জানান তিনি।’

শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে ওয়েটিং লিস্ট অনুসরণ না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার রেফারেন্সে ভর্তি করানো এবং অবৈধ অর্থ লেনদেনের অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজির হোসেন  বলেন, ‘মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির অনেক দুর্নীতির তথ্য আছে আমার কাছে। আমি দেবো। এমন তথ্য আছে, যেগুলো প্রকাশ হলে বিশ্ববিদ্যালয় নিউক্লিয়ার বোমার মতো ফাটবে, এসব তথ্য নিয়েও চুপচাপ বসে থাকি। তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে ভর্তির দুর্নীতির বিষয়ে প্রাক্তন এক ডিনের নাম উল্লেখ করেন এবং দাবি করেন যে, ওই ডিন কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি করেছেন।’


সর্বশেষ সংবাদ