২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১:০৫

‘পান থেকে চুন খসলেই’ সংঘর্ষে জড়ায় ঢাকা, সিটি ও আইডিয়াল কলেজ শিক্ষার্থীরা

ঢাকা কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজ  © লোগো

ঢাকা কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজ— রাজধানীর ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত সায়েন্স ল্যাব ও নিউ মার্কেট এলাকায় এই তিন কলেজের অবস্থান। কয়েক বছর ধরে স্লেজিং, কথা কাটাকাটি, কটূক্তির মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে 'পান থেকে চুন খসলেই' বড় ধরনের সংঘর্ষ হচ্ছে কলেজ তিনটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এতে শিক্ষার্থীদের আহত হওয়ার পাশাপাশি রাজধানীবাসীর জনদুর্ভোগেরও কারণ হচ্ছে। ভাঙচুর করা হয় সংঘর্ষের মধ্যে পড়া যানবাহনও।

সর্বশেষ গত বুধবার (২১ নভেম্বর) ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিন ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ শতাধিক শিক্ষক শিক্ষার্থী আহত হন। এ ঘটনার পর ঢাকা কলেজ একদিন ও সিটি কলেজ তিনদিন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

এ সংঘর্ষের কারণ হিসেবে জানা যায়, ঢাকা কলেজের ১৮৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান শেষে বাসযোগে সব শিক্ষার্থীরা একে একে বের হয়ে যায়। তিনটি বাস সায়েন্স ল্যাব মোড়ে পৌঁছালে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা বাসগুলো থামিয়ে কয়েকজনকে মারধর করে। তবে কী কারণে এ ঘটনা ঘটেছে তা এখনও স্পষ্ট জানা যায়নি। এরপর সায়েন্স ল্যাব মোড়ে চলে সংঘর্ষ।

জানা যায়, এই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ যেন এখন প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে। সায়েন্স ল্যাব ও নিউ মার্কেট এলাকা যেন এক অজানা যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। এই দ্বিমুখী বা ত্রিমুখী সংঘর্ষের ধ্বংসযজ্ঞে কখনো সিটি কলেজ ও ঢাকা কলেজ, কখনো আইডিয়াল কলেজ ও ঢাকা কলেজ আবার কখনো সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এই সহিংস পরিস্থিতি প্রায়ই কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 

এই মারামারির সূত্রপাত প্রায়ই হয় তুচ্ছ বিষয় নিয়ে—কোনো কোচিং সেন্টার, কথা কাটাকাটি, কিংবা খেলার ছোটখাট বিবাদ থেকে। এ ঘটনায় রাজনৈতিক কোনো তৎপরতার স্পষ্ট কোনো ছাপ দেখা যায় না। বরং, সেসব বিষয়ই হয়ে ওঠে উত্তেজনার মূল কারণ, যেখানে সামান্য তর্ক বা একে অপরের প্রতি ক্ষুদ্র তিক্ততার মতো সামান্য বিষয়গুলিই হয়ে ওঠে অগ্নিশিখা। কখনও কথার ভুল বোঝাবুঝি, কখনও অবহেলা, কখনও বা অহংকার—এসব ছোটখাটো ঘটনা যেন ক্রমেই একত্রিত হয়ে সৃষ্টি করে এক অদৃশ্য বিভেদ, যা মুহূর্তের মধ্যে পরিণত হয় বড় সংঘর্ষে।

তিন কলেজের দ্বন্দ্বের শুরুটা কোথায়, তা কেউ জানাতে পারেননি। তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, কোনোভাবে শিক্ষার্থীদের মাইন্ড সেটআপ করে দেওয়া হয়েছে যে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে মারামারিতে জড়াতে হবে এবং জিততে হবে। বর্তমান শিক্ষার্থীরা সাবেকদের কাছ থেকে এই শিক্ষা পেয়ে আসছেন।

তিন কলেজে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় মূলত একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। তাদের বেশির ভাগের বয়স থাকে ১৮ বছরের নিচে। তিন কলেজের শিক্ষার্থীরা বারবার সংঘর্ষে জড়ালেও কলেজ কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ যেমন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেয় না, নীরব থাকে। এজন্য কয়েক বছরে এই সংঘর্ষের ঘটনা প্রায় অনেকবার সংঘটিত হয়েছে।

এ বছরের ২৫ জানুয়ারিতে ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা সিটি কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এ সময় বাস ও লেগুনা ভাঙচুর করা হয়। তবে গুরুতর আহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। জানা যায়, সিটি কলেজের সামনে ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থীকে একা পেয়ে মারধর করেন সিটি কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী। পরে ওই শিক্ষার্থীকে সিটি কলেজে আটকে রাখা হয়। এই ঘটনা ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থীরা সিটি কলেজের দিকে এগিয়ে যায়। এর মধ্যে সিটি কলেজের সামনে, সায়েন্স ল্যাব এলাকা এবং ঢাকা কলেজের সামনের রাস্তায় কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসময় একটি লেগুনা ও বাসে ভাঙচুর করেন শিক্ষার্থীরা।

গত ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় ঢাকা কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১৮ জন আহত হন। যার মধ্যে বেশিরভাগই ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী। জানা যায়, ঢাকা কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠান শেষ করে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজয় চত্বরের নাঈমের গলি গেটের সামনে পৌঁছালে আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন। এতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর মাথা ফেটে যায়।

তাদের অভিযোগ, ঢাকা কলেজের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা হামলা করেছেন। তারা বলেন, সকালে আইডিয়াল কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে কে বা কারা মারধর করেছে। এই কারণে আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা মনে করেছে, ঢাকা কলেজের ছাত্ররা তাদের মারধর করেছে। এমন অভিযোগে তারা ঢাকা কলেজের ক্যাম্পাসে এসে আমাদের ওপর হামলা করে। এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে ঢাকা কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষে দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ কয়েকবার ধাওয়া পাল্টা হয়। এতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। সংঘর্ষের একপর্যায়ে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা আইডিয়াল কলেজের সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে যায়।

গত বছরে ফেব্রুয়ারিতে ‘মুরগি’ বলায় রাজধানীর সিটি কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে নটরডেম কলেজের একজন শিক্ষার্থীসহ মোট চারজন আহত হন। এ ঘটনায় উভয় কলেজের ৯ শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ। সংঘর্ষের সূত্রপাত হিসেবে জানা যায়, সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের ফটকে গিয়ে ‘তোরা মুরগি, সাহস থাকলে বের হ’ বলে চিৎকার করেন। এরপরই ২ কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

এরপর মার্চে ঢাকা কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন। ঘটনাটিতে প্রায় তিন ঘণ্টা রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব ও গ্রিন রোড এলাকায় যান চলাচল বন্ধ ছিল।

ঢাকা কলেজের ওমর ফারুক নামে স্নাতকের এক শিক্ষার্থী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, পূর্বের কোনো শত্রুতা ছাড়াই সংঘর্ষের ঘটনাগুলো ঘটছে। এটা শিক্ষার্থীদের মাইন্ড সেটআপ হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে এটা কমাতে গেলে শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

সিটি কলেজের শাহিনুর রহমান নামে এক শিক্ষার্থী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, এ ধরনের সংঘর্ষ কলেজের শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক সহিষ্ণুতা ও সম্মানের অভাবে হয়ে থাকে। সাধারণত খুব ছোট ছোট ব্যক্তিকেন্দ্রিক তুচ্ছ ঘটনা থেকে সংঘর্ষ বাঁধে এবং একে অপরের ওপর আধিপত্য বিস্তার লাভের জন্য করে থাকে।

সিটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কাজী নেয়ামুল হক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, আমাদের শিক্ষার্থীরা বুঝতে পেরেছে এটা তাদের ভুল ছিল। সেনাবাহিনীর মধ্যস্ততায় তারা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে ভবিষ্যতে এমন ভুল তারা আর কখনো করবে না। যদি কখনো ঝামেলা তৈরি হয় তা শিক্ষকদের জানাবে উভয়পক্ষ। এই বিষয়ে সাত কলেজ নিয়ে একটা কমিটি ও গঠন করা হয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের সকল অভিযোগ জানাতে পারবেন।

ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, বিষয়টি নিয়ে আমরা মোবাইল টিম গঠন করেছি। তারা ছুটির সময় এবং ক্লাস শুরুর আগে নিরাপত্তা এবং যেকোনো সহিংসতা এড়াতে কাজ করবে। মোবাইল টিমের সাথে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর একটা টিম ও থাকবে। যেকোনো সহিংসতা এড়াতে ওনারা খুব সতর্কতার সাথে দায়িত্ব পালন করবে। আর শিক্ষার্থীরাও প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের আশ্বস্ত করেছে তারা আর কখনো এমন ঘটনা ঘটাবে না।