তিতুমীরের আন্দোলন নিয়ে বির্তক, ফেসবুকে সমালোচনা
রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে মহাখালীতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে আন্দোলন করছেন কলেজটির শিক্ষার্থীরা। আজ সোমবার (১৮ নভেম্বর) বেলা ১১টার পর কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর দুপুরের দিকে নোয়াখালী থেকে ছেড়ে আসা ‘উপকূল এক্সপ্রেস’ ট্রেনে ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এতে নারী-শিশুসহ বেশ কয়েকজন যাত্রী আহত হন।
এরই মধ্যে যাত্রীদের রক্তাক্ত হওয়ার একাধিক ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তাছাড়া এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মহাখালী, বনানী, আমতলী, গুলশানসহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কে তীব্র যানজট দেখা দিয়েছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। ফলে বিষয়টি নিয়ে তীব্র সমালোচনা করছেন নেটিজেনরা।
নেটিজেনরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের যেকোনো দাবি নিয়ে আলোচনার টেবিলে না বসে সাধারণ মানুষের উপর হামলা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। নারী ও শিশুদের উপর যে হামলা হয়েছে এটা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ঘটনা। এমন ঘটনা চলতে থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তিও নষ্ট হবে।
ট্রেনে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও যাত্রী আহত হওয়ার বিষয়ে নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেইজে মতামত প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন। তিনি লেখেন, ‘তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ইট-পাটকেলে রক্তাক্ত ট্রেনযাত্রী, আহত অনেক। এইবার বুঝেন আমরা কেমন মানের শিক্ষার্থী তৈরি করছি। কদিন আগে ৭ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে আন্দোলন করেছে। এখন ৭ কলেজের ১ কলেজ স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি করছে। এই দাবি পূরণ হলে অন্যরাও স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ট্রেন বাসে ইটপাটকেল মেরে মানুষ মারবে বা আহত করবে। কিছু হলেই আন্দোলন। আন্দোলন মানেই সাধারণ মানুষকে জিম্মি।’
বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সংকট নিয়ে এই অধ্যাপক লেখেন, ‘পৃথিবীর কোন দেশে এমন শিক্ষার্থী আছে? নেতা নেত্রীরা যারা সরকার চালায় তারা কেন দাবির আগেই তাদের ভিশনের অংশ হিসাবে শিক্ষার্থী বান্ধব সিদ্ধান্ত নিতে পারে না? আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যে সত্যিকারের শিক্ষার্থী তৈরি করছে না তার একটা উদাহরণ এটি। গতকাল রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা মেধার ভিত্তিতে ভর্তির দাবিতে মিরপুর রোড অবরোধ করেছিল। ভর্তি কি কখনো লটারিতে হতে পারে? হতে পারে যদি সকল স্কুল কলেজ একই মানের হয়। সকল স্কুল কলেজ একই রকম উন্নত মানের হলে আরো অনেক ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত যেমন যে যেই এলাকার সে কেবল সেই এলাকার স্কুলে ভর্তি হতে পারবে। এতে ট্র্যাফিক জ্যাম কমতো। শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি করলে দেশের অনেক সমস্যা এমনিতেই সমাধান হয়ে যেত।’
তিতুমীর কলেজসহ রাজধানীর সাত কলেজ শিক্ষার্থীর বিভিন্ন দাবি নিয়ে রাস্তা অবরোধ ও অসহনীয় যানজটে নাগরিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টে মাহবুব কবির মিলন নামে সাবেক এক অতিরিক্ত সচিব লেখেন, ‘তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা দুইদিন পরপর তাদের কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে মহাখালী সড়ক অবরোধ করে যাচ্ছে। আজ ট্রেন আটকানোর চেষ্টা করে তাদের ছোঁড়া পাথরের আঘাতে ট্রেনের কয়েকজন যাত্রী আহত হয়েছে। এই বর্বরোচিত কাণ্ড কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ তিনি আরও লেখেন, ‘তাহলে কি এভাবে চলতেই থাকবে? তারা অনবরত অবরোধ করে নাগরিক জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে, হামলা করবে। আর সরকার চুপচাপ থাকবে! ফয়সালা কী এই সমস্যার?’
মো. কায়সার হামিদ নামে বেসরকারি খাতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা পুরোনো স্মৃতির কথা উল্লেখ করে তার ফেসবুক ওয়ালে লেখেন, ‘২০১৮ সালে আমার গাড়ি গুলশান স্বপ্নের সামনে নির্ধারিত পার্কিংয়ে থাকা অবস্থায় একজন এসে গাড়ির সামনের বাম্পার গ্রিল ভেঙে ফেলে! আমি ড্রাইভারকে কিছু না বলে তার কাগজপত্র নেই। পরে তাকে আমার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে তার মালিককে কল করতে বলে চলে আসি। মলিক ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। কিন্তু তার রেফারেন্সে তিতুমির কলেজের এক ছাত্র আমাকে ফোন করে তার রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে কাগজপত্র ফেরত চায়! তার কথার ধরণ দেখে আমি বললাম, আমরা কি বিশ্ববিদ্যালয় পাস না করেই জব করছি? একটু উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শেষে ২ ঘণ্টা আমার অফিসে দাড় করিয়ে রেখে তারপর কাগজ ফেরত দিয়েছিলাম!’
রাস্তা আটকিয়ে তিতুমির কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সমালোচনা করে এই কর্মকর্তা লেখেন, ‘রাস্তা বন্ধ করে, ট্রেন বন্ধ করে, ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে, যাত্রীদের পাথরের আঘাতে আহত করে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে এইভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে রেখে কি অর্জন করতে চায় তিতুমির কলেজের শিক্ষার্থীরা? এভাবে কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে আসলে কি অর্জন হবে? মৌলিক কি পার্থক্য হবে?’
জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা রাজধানীর মহাখালী রেল ক্রসিং এলাকায় বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। তাদের এ কর্মসূচির কারণে মহাখালী থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, মহাখালী থেকে সাত রাস্তা ও মহাখালী থেকে ফার্মগেট রাস্তায় যান চলাচল অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে যান চলাচল বন্ধ থাকায় এর প্রভাব পড়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। বিভিন্ন এলাকায় সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই যানজটের প্রভাব দেখা যায়।
এদিকে তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরে কমিশন গঠনের দাবিতে সচিবালয়ে অনশনে বসেছেন প্রতিষ্ঠানটির ১৪ শিক্ষার্থী। আজ সোমবার (১৮ নভেম্বর) প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অনশনে থাকার খবর পাওয়া গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন গঠনের দাবিতে বেশ কয়েকবার সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছিলেন তারা। সেই ধারাবাহিকতায় পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সোমবার সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত তারা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধিদল সচিবালয়ে সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করতে যান। অনশনে থাকা শিক্ষার্থীরা হলেন, মেহেদী হাসান মাল, মাহামুদুল হাসান, জাহাঙ্গীর সানি, আমিনুল, নুর উদ্দিন জিসান, কাউসার আহমেদ, মোশারফ হোসেন, তোহা, নুর মোহাম্মদ, হাবিব উল্লাহ রনি, আব্দুল হামিদ ও নিরব হোসেনসহ আরও দুইজন।