০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৬:০২

সার্টিফিকেট অর্জনের চেয়ে উত্তোলন কঠিন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে!

ইবির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর  © টিডিসি ফটো

প্রতিটি শিক্ষার্থীর স্বপ্নের জায়গা থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই জোর প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে শিক্ষার্থীরা। সবকিছু ভুলে পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়ে অর্জন করে নেয় কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আসন। কিন্তু এত কষ্টের পর সে যদি ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শেষ করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) থেকে, তাহলে তাকে নামতে হয় আরেকটি যুদ্ধে।

আর সেই যুদ্ধের নাম ‘সার্টিফিকেট উত্তোলনের যুদ্ধ’। ক্যাম্পাসে প্রচলিত রয়েছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট অর্জনের চেয়ে সার্টিফিকেট উত্তোলন কঠিন। বিশ্ববিদ্যালয়টির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের পদে পদে ভোগান্তি এই কথাটিকে যেন সার্থক করে তুলেছে। 

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট উত্তোলন, মার্কশিট উত্তোলনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে জীবনে একবার হলেও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের শরণাপন্ন হতে হয় শিক্ষার্থীদের। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরে একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট, নম্বরপত্র ও সনদসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উত্তোলন করতে গিয়ে চরম হয়রানির শিকার হয় তারা।

কর্তৃপক্ষের অবহেলা, সমন্বয়হীনতা, জায়গা ও লোকবল সংকটের ফলে বছরের পর বছর ধরে সনদ উত্তোলনসহ জরুরি কাজ করতে গিয়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এতে সময়ের পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির ও শিকার হচ্ছে তারা। সামান্য একটি কাজে যেয়ে দিনের পর দিন ঘুরতে হয় এই টেবিল থেকে ওই টেবিলে, হজম করতে হয় কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহারের। 

আরও পড়ুন: ঢাবিতে অনলাইনে সনদ উত্তোলনেও ভোগান্তিতে শিক্ষার্থীরা

বিভাগের ফলাফল প্রকাশ, একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট, নম্বরপত্র ও সনদপত্র প্রদানের কাজ করে থাকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর। সাধারণভাবে আবেদনের ১৫ দিনের মধ্যে এবং জরুরি ভিত্তিতে ৫ দিনের মধ্যে কাগজপত্র প্রদানের নিয়ম থাকলেও মাসের পর মাস কেটে গেলেও মেলেনা কাঙ্ক্ষিত সেবা। ঘটে আবেদনপত্র হারিয়ে ফেলার মতো ঘটনা, অভিযোগ রয়েছে নিয়মবহির্ভূত অর্থ লেনদেনের।

এছাড়া অফিস সময়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কর্মকর্তাদের পাওয়া না গেলেও তাদের আমবাগানে বসে লুডু খেলতে, আড্ডা দিতে; সাথে রয়েছে ‌‌‘লাঞ্চের পর আসেন’ বলার মতো সংস্কৃতি চর্চার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু লাঞ্চের পরে দেখা যায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কেউ কেউ চলে গিয়েছেন দুপুর ২টার বাসে। আবেদন ও সত্যায়নের জন্য ব্যাংক, বিভাগ ও আবাসিক হলে ঘুরতে হয় শিক্ষার্থীদের। 

সংশ্লিষ্ট দপ্তর সূত্রে জানা যায়, সার্টিফিকেট উত্তোলন এবং প্রতি সেমিস্টারের মার্কশিট প্রদানের ক্ষেত্রে জনবল রয়েছে মাত্র একজন। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটারাইজড ব্যবস্থা থাকলেও ইবিতে এখনো রয়েছে হাতে লেখা সার্টিফিকেটের চল। ৩৬টি বিভাগ ছাড়াও সান্ধ্যকালীন কোর্সের সার্টিফিকেটও একজনের মাধ্যমেই দেওয়া হয়। অপরদিকে, মাত্র একজন ব্যক্তি ৩৬টি বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রতি সেমিস্টারের মার্কশিট, ২টি বিভাগের রেজাল্ট এবং প্রবেশপত্র প্রস্তুতের কাজ করেন।

দীর্ঘদিন যাবত নিয়োগ বন্ধ থাকায় এসব দপ্তরগুলোতে লোকবল সংকট এখন চরমে। এছাড়া পিয়ন ও কর্মচারী পদে নিয়োগের পর অনেকে পদোন্নতি পেয়ে কর্মকর্তা হয়ে গেছে। ফলে পর্যাপ্ত সংখ্যক কর্মকর্তা থাকলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী না থাকায় সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।

সরজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের উত্তর ব্লকের তৃতীয় তলায় অবস্থিত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের কাউন্টার ও অফিস কক্ষগুলোর সামনে শিক্ষার্থীদের ভিড়। কক্ষের দরজায় গোপনীয় শাখা লেখা থাকলেও বালাই নেই কোনো গোপনীয়তা রক্ষার। পর্যাপ্ত সময় ও জনবল না থাকায় বাধ্য হয়ে হাতে হাতে কাজ করিয়ে নেয় শিক্ষার্থীরা।

এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১৭ হাজার শিক্ষার্থীর সার্টিফিকেট লেখার জন্য দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র একজন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেবা পেতে পেরিয়ে যায় মাসের পর মাস। এছাড়াও সার্টিফিকেট তুলতে গিয়ে নানা রকম অতিরিক্ত পরীক্ষার ফি এবং হিডেন চার্জ দিতে হয় বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তাদের জানামতে কোন বকেয়া নেই, কিন্তু সার্টিফিকেট তোলা জরুরি তাই সেখানে বাধ্য হয়ে টাকাটা দিতে হয়। অনেকেরই বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দিতে হবে, এজন্য সনদ তোলা প্রয়োজন তাই ঝামেলা এড়ানোর জন্য সবাই টাকাটা দিয়ে দিচ্ছে। এসআইয়ের পরীক্ষা আছে সামনে। আরো বিভিন্নজন বিভিন্ন রকম পরীক্ষা দিচ্ছে। তাই সার্টিফিকেট তোলাটা জরুরি। যেখানে পরীক্ষার ফি না দিলে প্রবেশপত্র ছাড় হয় না সেখানে আমরা আগে যে টাকা গুলো দিয়েছি সেগুলো তাহলে কোথায় গেল, সেটা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের রেজওয়ান বলেন, মার্কশিট, ট্রান্সক্রিপ্ট, ফলাফল প্রকাশের সনদ নিয়ে প্রশাসনের লোকজনের কাছে কাগজপত্র চাইলে মনে হয় যেন আমরা টাকা বা লোন চাচ্ছি। করোনাকালীন সময়ে আমাদের ফি ১ হাজার ৬৩০ টাকা কমানো হলেও সনদ তুলতে গিয়ে আমরা জানতে পারছি যে ওই টাকাও এখন দিতে হবে। আবার পরীক্ষা ফি না দিলে যেখানে কেউ পরীক্ষায় বসতেই পারে না সেখানে তারা বলে আমাদের ফি বাকি। রশিদ চাইলে বলে ভার্সিটির শুরু থেকে শেষ সব সেমিস্টারের রশিদ নিয়ে যেতে। ৫/৬ বছর ধরে কেও ওগুলো জমা রাখে না এটাই স্বাভাবিক। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ কে আজাদ লাভলু বলেন, আমাদের জায়গা ও লোকবল সংকট দুটোই রয়েছে। কয়েকজনকে দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে কাজ করাচ্ছি কিন্তু সেটাও অপ্রতুল। ইতোমধ্যে কয়েকজন মারা গেলেও নতুন নিয়োগ হয়নি। আবার অনেকেই গুরুতর অসুস্থ থাকায় কাজ করতে পারে না। আমরা চেষ্টা করছি আমাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়েও শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার।