বাকৃবির গবেষণা
দেশে সাড়ে তিন শতাংশ ঘোড়ার মধ্যে প্রাণঘাতী ‘গ্ল্যান্ডার্স’ জীবাণুর উপস্থিতি
- মো আমান উল্লাহ, বাকৃবি
- প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:১৩ PM , আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:১৩ PM
গ্ল্যান্ডার্স ঘোড়ার একটি অতিপ্রাচীন ও মারাত্মক ছোঁয়াচে জুনোটিক রোগ। এই রোগ ঘোড়া থেকে মানুষে সহজে ছড়াতে পারে। বাংলাদেশে গ্ল্যান্ডার্সের উপস্থিতি নির্ণয় এবং রোগের ঝুঁকি সৃষ্টিতে যে-সব কারণগুলো ভূমিকা রাখে তা জানার জন্য ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি অনুষদের মেডিসিন বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. মো. সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে একই বিভাগের অধ্যাপক ড. এ. কে. এম আনিসুর রহমানের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত কর্নেল পলাশ কুমার ভট্টাচার্য্য একটি গবেষণা কর্ম পরিচালনা করে আসছেন। মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) বাকৃবির মেডিসিন কনফারেন্স রুমে কর্নেল পলাশ কুমার ভট্টাচার্য্য তার পিএইচডির সেমিনারে এই গবেষণা সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেন।
গবেষণার আওতায় ঢাকা, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম ও চট্টগ্রাম জেলায় প্রতিপালিত ৭৫৩ টি ঘোড়া থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এসব নমুনা বাকৃবির মেডিসিন বিভাগের ল্যাবরেটরি, জার্মানির ফ্রেডেরিখ লোফলর ইনস্টিটিউট (FLI) এবং ভারতের ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার অফ ইকুয়াইনে (NRCE) এ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়। কাজটিতে ঐ দুটি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী যথাক্রমে ড. হেনরিখ নইবার ও ড. হরিশংকর সিংহ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও গবেষণা সহায়তা প্রদান করেন।
গবেষণা সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেন গবেষকরা
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি অনুষদের মেডিসিন বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘গ্ল্যান্ডার্স রোগটি পশ্চিমা বিশ্ব থেকে নির্মূল হলেও এখনও মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এটির উপস্থিতি বিদ্যমান। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে এ রোগের প্রকোপ রয়েছে। এসব দেশে ২০০৬ সাল থেকে এ রোগের পুনরুত্থান (Re-emergence) ঘটেছে।’
অধ্যাপক সিদ্দিকুর আরও বলেন, ‘আমাদের সাথে প্রতিবেশী দেশের ৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি স্থল সীমান্ত রয়েছে, যার অনেক স্থান সুরক্ষিত নয়। ফলে এ সীমান্ত এরিয়া দিয়ে প্রায়শই অবৈধভাবে ঘোড়াসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণী চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে প্রবেশ করে৷ ফলে প্রাণীর সাথে ঐ প্রাণীর রোগসমূহও দেশে চলে আসে। তাই দেশের ঘোড়ার মধ্যে গ্ল্যান্ডার্সের উপস্থিতি থাকা স্বাভাবিক। তবে ইতিপূর্বে বাংলাদেশে এ রোগের উপস্থিতি আছে কিনা তা নিয়ে কোন গবেষণাকর্ম পরিচালিত না হওয়ায় এ সম্পর্কে কোন ধারণা পাওয়া যায়নি, যা শুধু প্রাণী স্বাস্থ্যই নয়, জন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করেছে।’
বাকৃবি থেকে পরিচালিত গবেষণা অনুযায়ী ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও জামালপুর হতে সংগৃহীত নমুনায় গ্ল্যান্ডার্স এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গবেষণা মোতাবেক শতকরা ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ ঘোড়ার মধ্যে এ রোগের জীবাণুর উপস্থিতি দেখা গেছে। গবেষণায় পুরুষ ঘোড়ার মধ্যে গ্ল্যান্ডার্সে আক্রান্তের হার বেশি। এছাড়াও যে-সব ঘোড়ার বয়স ৬ বছরের বেশি এবং গাড়ি টানায় ব্যবহৃত হয় সেসব ঘোড়ার এই রোগে বেশি আক্রান্ত। প্রাপ্ত ফলাফলে আরও দেখা গেছে, এই রোগে আক্রান্ত ঘোড়ার রোগ সম্পর্কিত লক্ষণের উপস্থিতি ন্যূনতম অর্থাৎ রোগটির জীবাণু ঘোড়াসমূহে সুপ্ত অবস্থায় ছিল।
গবেষক কর্নেল পলাশ কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘গবেষণার আওতায় পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, ঘোড়া পালনে সরাসরি জড়িত বেশিরভাগ মানুষের এ রোগ সম্পর্কে ধারণা নেই। বিশেষত স্বল্প শিক্ষিত ঘোড়া পালনকারীদের অধিকাংশই রোগ সম্পর্কে অবগত ও সচেতন নয়। এমনকি কোন ছোঁয়াচে রোগ হলে যে সকল স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হয় সে সম্পর্কেও তারা ওয়াকিবহাল নয়। এই রোগের জীবাণুর নাম Burkholderia mallei যা আমেরিকান রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (CDC) কর্তৃক ক্যাটাগরি বি (B) জৈব সন্ত্রাসী উপাদান হিসেবে তালিকাভুক্ত।’
পলাশ কুমার ভট্টাচার্য্য আরও বলেন, ‘এ রোগের জীবাণু যুদ্ধ ক্ষেত্রে বায়োলজিক্যাল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার নজির আছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন যুদ্ধ বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী এই জীবাণু ব্যবহার করেছে। এ রোগে আক্রান্ত হলে মানুষ ও ঘোড়ার মৃত্যুর সম্ভাবনা ব্যাপক, কারণ এ রোগের চিকিৎসা এখনও অপ্রতুল। এ অবস্থায় জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি লাঘবে জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় পর্যায়ে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করত ৪ থেকে ৫ বছর মেয়াদি মনিটরিং এবং সার্ভিল্যান্স কর্মসূচি গ্রহণ জরুরি। এছাড়া সরকারি উদ্যোগে বড় পরিসরে রোগ নিয়ে আরও গবেষণা পরিচালনা এবং গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে গ্ল্যান্ডার্স প্রতিরোধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।’
প্রসঙ্গত, গ্ল্যান্ডার্স ঘোড়া থেকে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীতে ছড়াতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত হলে জ্বর, চামড়ায় মারাত্মক ক্ষত, সন্ধিস্থল ফুলে যাওয়া, শ্বাস কষ্ট, রোগা হয়ে যাওয়া, কাশি, নাক দিয়ে ঘন শ্লেষ্মা নির্গত হওয়া, চামড়ায় অ্যালার্জির মত নডিউল হওয়া ইত্যাদি দেখা যায়। তবে ঘোড়ার এই রোগের জীবাণু দীর্ঘদিন সুপ্ত অবস্থায় রোগের লক্ষণ প্রকাশ ছাড়া অবস্থান করে রোগ ছড়াতে পারে।