সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের খাতা পুনঃনিরীক্ষা নিয়ে ঢাবির ‘ব্যবসা’
অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ব্যবসা করছে বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের। সম্প্রতি পুনঃভর্তির জরিমানা ফি দ্বিগুণ করায় সে অভিযোগ নতুন করে সামনে এসেছে। যদিও শিক্ষার্থীরা বলছেন, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের খাতা পুনঃনিরীক্ষা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা চলছে বেশ কিছু দিন থেকেই। ঢাবিতে শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্র দুইজন মূল্যায়ন করলেও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়ন হয় একজনের হাতে। ফলে কখনো কখনো গণহারে ফেলের মত পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয় বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
ফেল করা শিক্ষার্থীদের প্রতিটি বিষয়ে পুনঃনিরীক্ষার জন্য গুণতে হয় মোটা অংকের টাকা। প্রতি বিষয়ে ৮০০ টাকা করে পুনঃনিরীক্ষার জন্য নেয়া হলেও খাতা নতুন করে দেখা হয় না। শিক্ষার্থীরা বলছেন, খাতার নম্বর নতুন করে যোগ করে পুনঃনিরীক্ষার ফল দেয়া হয়। ফলে ফলাফল পরিবর্তনের নজিরও কম। অন্যদিকে পুনঃনিরীক্ষার জন্য মোটা অংকের টাকা খরচ হলেও আশানরূপ ফল পান না শিক্ষার্থীরা।
আরও পড়ুন : দ্বিগুণ জরিমানায় পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের, ক্ষোভ
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি উত্তরপত্র দুজন পরীক্ষক মূল্যায়ন করে থাকেন। অন্যদিকে শুরু থেকেই অধিভুক্ত সাত কলেজের উত্তরপত্র একজন পরীক্ষক মূল্যায়ন করছেন। যার ফলে বিভিন্ন কোর্সে দেখা যায় গণহারে ফেল। ফেল করার পরও খাতা পুনঃনিরিক্ষণের জন্য আবেদন করে সেখানেও পুনরায় মূল্যায়ন করা হয় না। শুধুমাত্র খাতার নম্বর গণনা করা হয়। এরপরও প্রতি সেশনের শিক্ষার্থীরা প্রতিবারই বিভিন্ন কোর্সের খাতা পুনঃনিরিক্ষণের জন্য আবেদন করে। আবেদনেও দেয়া লাগে মোটা অংকের টাকা। প্রতিটি কোর্সের জন্য লাগে ৮০০ টাকা। শুধু নম্বর গোণার জন্য এ ফিয়ের পরিামান নিয়েও শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন রয়েছে। সাত কলেজের অনেক শিক্ষার্থী ভালো পরীক্ষা দিয়েও বিশ্বাস করতে পারে না যে তাদের ফেল আসবে। শুধু পাস করার জন্যই নয়, ভালো ফলাফলের প্রত্যাশায় শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়াদৌড়ি করে আবেদন জমা দিয়ে আসে, যেন কর্তৃপক্ষ তাদের খাতা আবার মূল্যায়ন করে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের এ ব্যাপারে কোনো কর্ণপাত নেই। উল্টো খাতা পুনরায় মূল্যায়ন না করে পুনঃনিরিক্ষণের মাধ্যম দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
শিক্ষার্থীদের দাবি, সাত কলেজের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের (7college.du.ac.bd) তথ্যমতে গত দেড় বছরে বিভিন্ন সেশনের শিক্ষার্থীরা মিলে পুনঃনিরিক্ষণের আবেদন করেছে দুই সহস্রাধিক জন। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও ফলাফল পরিবর্তন হয়েছে মাত্র ৩৪ জনের। মাঝে থেকে ঢাবি হাতিয়ে নিয়েছে ১৮ লাখ ১৬ হাজার টাকা।
আরও পড়ুন : স্বতন্ত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দাবি সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ২০২২ সালের অনার্স ১ম বর্ষ থেকে ৪২৮ জন, ২য় বর্ষ থেকে ১৪৪ জন, ৩য় বর্ষ থেকে ১৩৮ জন, ৪র্থ বর্ষ থেকে ৪৩১ জন এবং মাস্টার্স শেষপর্ব থেকে ২৬ জন শিক্ষার্থী পুনঃনিরিক্ষণের আবেদন করেছে। কিন্তু ফলাফল পরিবর্তন হয়েছে মাত্র ১৫ জন শিক্ষার্থীর। যদিও এখনো অনেক বিভাগের পুনঃনিরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা বাকি রয়েছে। ২০২১ সালের অনার্স ১ম বর্ষ থেকে ২৫৪ জন, ২য় বর্ষ থেকে ২৩০ জন, ৩য় বর্ষ থেকে ৬৫ জন, ৪র্থ বর্ষ থেকে ১১৩ জন এবং মাস্টার্স শেষপর্ব থেকে ৫০ জন শিক্ষার্থী পুনঃনিরিক্ষণের আবেদন করেছে। কিন্তু ফলাফল পরিবর্তন হয়েছে মাত্র ১২ জনের। ২০২২ সালের অনার্স ১ম বর্ষ, ২য় বর্ষ ও মাস্টার্স শেষপর্ব এবং ২০২১ সনের অনার্স ১ম বর্ষ ও মাস্টার্স শেষপর্বের পুনঃনিরীক্ষার আবেদনকৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে কারোর ফলাফলই কোনোরূপ পরিবর্তন হয়নি। সব থেকে খারাপ অবস্থা বিভিন্ন বর্ষের অনার্স, মাস্টার্স, ডিগ্রির 'বিশেষ' শিক্ষার্থীদের ফলাফলে। গত দেড় বছরে প্রায় ৩৯১ জন শিক্ষার্থী পুনঃনিরিক্ষণের আবেদন করলেও ফলাফল পরিবর্তন হয়েছে মাত্র ৭ জনের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজগুলো হলো, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ২০২২ সালের অনার্স ১ম বর্ষ থেকে ৪২৮ জন, ২য় বর্ষ থেকে ১৪৪ জন, ৩য় বর্ষ থেকে ১৩৮ জন, ৪র্থ বর্ষ থেকে ৪৩১ জন এবং মাস্টার্স শেষপর্ব থেকে ২৬ জন শিক্ষার্থী পুনঃনিরিক্ষণের আবেদন করেছে। কিন্তু ফলাফল পরিবর্তন হয়েছে মাত্র ১৫ জন শিক্ষার্থীর। যদিও এখনো অনেক বিভাগের পুনঃনিরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা বাকি রয়েছে। ২০২১ সালের অনার্স ১ম বর্ষ থেকে ২৫৪ জন, ২য় বর্ষ থেকে ২৩০ জন, ৩য় বর্ষ থেকে ৬৫ জন, ৪র্থ বর্ষ থেকে ১১৩ জন এবং মাস্টার্স শেষপর্ব থেকে ৫০ জন শিক্ষার্থী পুনঃনিরিক্ষণের আবেদন করেছে। কিন্তু ফলাফল পরিবর্তন হয়েছে মাত্র ১২ জনের। ২০২২ সালের অনার্স ১ম বর্ষ, ২য় বর্ষ ও মাস্টার্স শেষপর্ব এবং ২০২১ সনের অনার্স ১ম বর্ষ ও মাস্টার্স শেষপর্বের পুনঃনিরীক্ষার আবেদনকৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে কারোর ফলাফলই কোনোরূপ পরিবর্তন হয়নি। সব থেকে খারাপ অবস্থা বিভিন্ন বর্ষের অনার্স, মাস্টার্স, ডিগ্রির 'বিশেষ' শিক্ষার্থীদের ফলাফলে। গত দেড় বছরে প্রায় ৩৯১ জন শিক্ষার্থী পুনঃনিরিক্ষণের আবেদন করলেও ফলাফল পরিবর্তন হয়েছে মাত্র ৭ জনের।
সরকারি বাঙলা কলেজের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির হাওলাদার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রথমবর্ষ পরীক্ষা পাস করার চেয়েও ভালো দিয়ে দেখা যায় ছয়টি বিষয়ে ফেল। পরে কলেজের অধ্যক্ষের সুপারিশসহ আমরা খাতা পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করি। শুধু ননমেজর বিষয় রসায়নের খাতা পুনর্মূল্যায়ন করা হলে দেখা যায় পাস করেছি। কিন্তু ৪ হাজার টাকা খরচ করে বাকি পাঁচটি বিষয়ে খাতা পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করেও কোন ফল পাইনি।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষাবোর্ডগুলো লাখ লাখ শিক্ষার্থীর খাতা থেকে একটি খাতা বের করে পুননিরীক্ষা করতে ১৫০ টাকা ফি নেয়। সেখানে ঢাবি প্রতি ব্যাচের কয়েকশ শিক্ষার্থীর খাতার মধ্য থেকে একটি খাতা বের করে নতুন করে যোগ করতে ফি নেয় ৮০০ টাকা। এটিকে ব্যবসা ছাড়া আর কী বলবেন।
সরকারি তিতুমীর কলেজের ২০২১-২২ সেশনের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রথমবর্ষ পরীক্ষায় চারটি বিষয়ে ফেল এসেছিল। যদিও পাসের বিষয়ে অনেকটা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু ফেল করায় হতবাক হয়ে আবেদন করেছিলাম খাতা পুনঃনীরিক্ষার। কিন্তু প্রথমেই জানানো হয় খাতা পুনঃনিরীক্ষার ক্ষেত্রে ওএমআর শিটের নম্বর ফের গণনা করা হয়। কিন্তু খাতা নতুন করে দেখা হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বন্ধুদের কাছে জেনেছি, খাতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে স্বয়ং বিভাগীয় প্রধান ওই খাতা দেখেন আর আমরা সাত কলেজ বলে নম্বর গুণেই কাজ শেষ। প্রতিটি বিষয়ের জন্য ৮০০ টাকা ফি নেয়া হয় শুধু ওএমআর শিটের নম্বর নতুন করে যোগ করার জন্য। ৩ হাজার ২০০ টাকা খরচ করে চারটি বিষয়ের খাতা পুণর্নিরীক্ষার আবেদন করেও কোন ফল পাইনি।
এসব বিষয়ে মন্তব্য জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বাহালুল হক চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের একটি সূত্র দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানা যায়, সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. মনিরুল ইসলাম অধিভুক্ত সাত কলেজের বিষয়টি তদারকি করেন।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. মনিরুল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, পুনঃনিরীক্ষা বিষয়টির অর্থই হলো উত্তরপত্রের নম্বর যোগ করা। আমরা পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করতে আশা শিক্ষার্থীদের বিষয়টি জানিয়ে থাকি।
শুধু বিশেষ পরিস্থিতিতে খাতা পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। যদি কোন ব্যাচের ৭০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ফেল করে সেক্ষেত্রে অধ্যক্ষ ও সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সমন্বয়কের সুপারিশের প্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে মানবিক বিবেচনায় তা পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। -ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. মনিরুল ইসলাম
পুনর্মূল্যায়নের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, শুধু বিশেষ পরিস্থিতিতে খাতা পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। যদি কোন ব্যাচের ৭০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ফেল করে সেক্ষেত্রে অধ্যক্ষ ও সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সমন্বয়কের সুপারিশের প্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে মানবিক বিবেচনায় তা পুনর্মূল্যায়ন করা হয়।
খাত পুনঃনিরীক্ষার ফিয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, পুনঃনিরীক্ষার ফিয়ের টাকা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ অফিস বা আমার পকেটে যায় না। এটি আমরাও নির্ধারণ করি না। শিক্ষার্থীরা যদি মনে করেন খাতার যোগফল দেথার জন্য এ ফিয়ের পরিমান বেশি তাহলে তারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করুক। আশা করি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন।
একজন পরীক্ষকের মাধ্যমে খাতা মূল্যায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, ঢাবি শিক্ষার্থীদের খাতা দুইজন পরীক্ষক মূল্যায়ন করেন। সে দুইজনের নম্বরের পার্থক্য ২০ শতাংশের বেশি হলে খাতা তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে যায়। কিন্তু সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের খাতা একজন পরীক্ষক দেখেন। সেটিও নির্ধারণ হয় পরীক্ষা কমিটির মাধ্যমে। পরীক্ষা কমিটির সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কমিটি যার কাছে খাতা পাঠায় তিনিই খাতা দেখেন।