০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৩৬

৩০ বছরে ইবির কেন্দ্রীয় মসজিদের নির্মাণকাজ হয়েছে ৫০ শতাংশ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে  © টিডিসি ফটো

১৯৯৪ সালে শুরু হয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) কেন্দ্রীয় মসজিদের নির্মাণকাজ। এরপর পার হয়েছে প্রায় ৩০ বছর। তবে আজও সে কাজ শেষ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। নির্মাণকাজ আটকে রয়েছে প্রজেক্ট পাস আর দাপ্তরিক ফাইলে। অথচ এরইমধ্যে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে বিদায়ও নিয়েছে। বদলেছে প্রধান প্রকৌশলীসহ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজের নির্ধারিত মেয়াদও শেষ হয়েছে। শুধু শেষ হয়নি মসজিদের কাজ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নবনিযুক্ত উপাচার্যের হাত ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের সংস্কার ও নির্মাণকাজ শেষ হবে বলে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন শিক্ষার্থীরা। 

নির্মাণশৈলীর দিক থেকে আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা ইবির মসজিদটি। তবে ৩০ বছর ধরে নির্মাণাধীন অবস্থায় পড়ে আছ। বাকি কাজ শেষ হবে কবে, তা জানেন না খোদ কর্তাব্যক্তিরাই। এ নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। তাদের মতে, নবনিযুক্ত ১৪তম উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকিব মোহাম্মদ নসরুল্লাহর সময়েও যদি কেন্দ্রীয় মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ না হয়, তাহলে আর পূর্ণতা পাবে না।

১৭ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় মসজিদের অবশিষ্ট নির্মাণকাজে ব্যয়ের কথা ছিল। সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম আলাউদ্দিন ২০০৯ সালে মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো অর্থ বরাদ্দের অনুমোদনপত্রে স্বাক্ষর করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি অংশ মসজিদের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা অন্য খাতে ব্যবহারের জন্য ঊর্ধ্বতন মহলে জোর তৎপরতা চালায়। পরে প্রশাসনের সিদ্ধান্তহীনতায় সে টাকা মন্ত্রণালয়ে ফেরত যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্মাণকাজ শুরুর পর ৩০ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের কাজ মাত্র ৫০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ১৯৯৪ সালে সরকারি অর্থায়নে শুরু হলেও পরবর্তীতে বৈদেশিক সহায়তা নিয়ে নির্মাণকাজ এগোতে থাকে। মসজিদের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা ভিন্ন খাতে ব্যয় ও সঠিকভাবে কাজে না লাগানোর অভিযোগে বিদেশি প্রতিষ্ঠান অর্থ ফেরত নিলে নির্মাণকাজ থমকে যায়। ২০০৮ সালে খুলনা সার্কিট হাউজে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরদ্দীন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নে গৃহীত প্যাকেজ প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে ইবিতে ২২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

এর মধ্যে ১৭ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় মসজিদের অবশিষ্ট নির্মাণকাজে ব্যয়ের কথা ছিল। সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম আলাউদ্দিন ২০০৯ সালে মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো অর্থ বরাদ্দের অনুমোদনপত্রে স্বাক্ষর করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি অংশ মসজিদের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা অন্য খাতে ব্যবহারের জন্য ঊর্ধ্বতন মহলে জোর তৎপরতা চালায়। পরে প্রশাসনের সিদ্ধান্তহীনতায় সে টাকা মন্ত্রণালয়ে ফেরত যায়।

তিন দশকেও নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে আল হাদীস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের আবদুল্লাহ নুর মিনহাজ বলেন, ‘আমরা গর্বের সঙ্গে প্রচার করি, আমাদের মসজিদ বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম এবং ক্যাম্পাস ভিত্তিক সর্ববৃহৎ। শুধু মসজিদটির সম্মুখভাগে রং করে দিয়েছে। বাইরে থেকে সুউচ্চ মিনারগুলো দেখতে সুন্দর হলেও ভেতরকার অবস্থা বিপরীত।

তিনি বলেন, জুমার নামাজের পর সবাই ছবি তুলতে পারে, পর্যটকরা মসজিদের সামনে এসে ছবি তুলতে পারেন- এটুকুই। খতিব প্রাণবন্ত আলোচনা করলেও বাজে সাউন্ড সিস্টেমের কারণে কি বলছেন তা শোনা যায় না। এসি নেই, পর্যাপ্ত ফ্যানও নেই। সবাই গরমে-ঘামে একাকার হয়ে যান। এতদিনেও মসজিদের কাজ শেষ করতে না পারা প্রশাসনের চরম ব্যর্থতা।

সরজমিনে দেখা যায়, মসজিদের উত্তর-দক্ষিণে প্রবেশের ব্যবস্থা থাকলেও কোনও ফটক নেই। নিচতলায় একাধিক তালাবদ্ধ কক্ষ, ফাঁকা স্থানে মরা ডালপালা। দুটি কক্ষে আনসার সদস্যদের আবাসন। অফিস সহায়ক সমিতির নাম সম্বলিত অফিস কক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, ইমামের কক্ষ ও একটি অজুখানা দেখা যায়। নিচতলা থেকে দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি পর্যন্ত টাইলস বাঁধাই থাকলেও এরপর চতুর্থ তলা পর্যন্ত সিঁড়িতে নেই টাইলসের অস্তিত্ব। নিরাপত্তা ঘাটতির কারণে ২০২২ সালের ৮ জুন রাতে চারটি বড় স্ট্যান্ড ফ্যান চুরি হয়ে যায়।

এছাড়াও ফ্যান ও সাউন্ড সিস্টেম সংকট, মাদুরে অভাব এবঙ জুতা-স্যান্ডেল রাখার ব্যবস্থাও ঠিকমতো নেই। জুমার দিনে অধিক মুসল্লির আগমনের কারণে অজুখানায় দিতে হয় লম্বা লাইন। বাজে সাউন্ড সিস্টেম, দুর্বল যন্ত্রপাতি লাগানোর পাশাপাশি দেয়ালে লোনা ধরার কারণে রং চটে যাচ্ছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে নষ্ট হচ্ছে সৌন্দর্য। মসজিদের ভেতরে বাদুড় ও মাকড়শার বাসা। গ্রিল, জানালার গায়ে ধরেছে মরিচা। নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না মসজিদের আশপাশের ঝোপ-জঙ্গল।

মসজিদের কাজ শুরুর পর নানা কারণে কাজ বন্ধ হয়ে গেলেও তিন ধাপে অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হয় বলে জানা গেছে। ২০০৪ সালে ৩৬ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়। আর ২০১৭ সালে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. রাশিদ আসকারীর সময় দুই ধাপে সাড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মসজিদটির ৫০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। নির্মাণকাজ শেষে দেশের প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সর্ববৃহৎ মসজিদ হবে ইবির কেন্দ্রীয় মসজিদ।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিমাংশে ২.২৫ হেক্টর জায়গাজুড়ে মসজিদের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করা হয়। এর গ্রাউন্ড ফ্লোরের আয়তন ৫১ হাজার বর্গফুট। চারতলা বিশিষ্ট মসজিদের মূল অংশে সাত হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন। এছাড়া সামনের অংশের বারান্দায় নামাজ পড়তে পারবেন আরো ১০ হাজার মুসল্লি।

নবনিযুক্ত উপাচার্যের কাছে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, অন্য বিষয়ের সঙ্গে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদও ভালো অবস্থায় নিয়ে যাবেন। তিনি কেন্দ্রীয় মসজিদ নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিবেন এবং বাস্তবায়নে তৎপর হবেন। প্রথম দিন এসেই তিনি কেন্দ্রীয় মসজিদে আসর নামাজও আদায় করেছেন।

আরো পড়ুন: শাবিপ্রবিতে আশ্বাস দিয়েও পদত্যাগ করেননি ডিন, আল্টিমেটাম শিক্ষার্থীদের

বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী তানভীর মন্ডল বলেন বলেন, কেন্দ্রীয় মসজিদের সাউন্ড বক্সের সমস্যা দীর্ঘদিনের। প্রশাসনের তদারকির অভাবে এটির কোন সমাধান হয় না। মসজিদটি ক্যাম্পাসের অন্যতম সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থাপত্য। অনেকেই জুমার দিন ইমামের আলোচনা শুনতে বাইরে থেকে আসেন। শব্দ বিভ্রাটের কারণে ইমাম কি বক্তব্য রাখেন, তা মুসল্লিরা বুঝতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট জোর দাবি জানাব, অতি দ্রুত শব্দবিভ্রাটের অবসান হোক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘আমি আলোচনার বিষয়গুলো পড়াশুনা করে সঠিক মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু শব্দ বিভ্রাটের কারণে আমার আলোচনা মুসল্লিদের বোধগম্য হয় না। এটা দীর্ঘদিনের সমস্যা বলে শুনেছি। আমি চাই দ্রুত সমস্যার সমাধান করা হোক।’

অসমাপ্ত কাজের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম শরীফ উদ্দীন বলেন, এটি আমাদের অনেক বড় প্রকল্প। উপমহাদেশের বেশকিছু মসজিদের সঙ্গে এটি সমাপ্ত হবে। বড় প্রকল্প হওয়ার ঠিকমতো বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কাজে দেরি হচ্ছে।

বরাদ্দ ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, বাইরে থেকে কোনও বরাদ্দ আসছে কি না এ ব্যাপারে আমার জানা নেই। আমি দায়িত্বে আসার পর দেখছি, পুরোপুরি সরকারি অর্থায়নেই হচ্ছে এ প্রকল্পটি। আর নকশা যেটা করা হয়েছে, সেটা কমপ্লিট হবে। নিচতলা বেশকিছু অফিসের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। সম্পন্ন হওয়ার পর প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেবে কি করবে সেখানে।