অভিভাবক শূন্য জবি, নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিসি পেতে আন্দোলন
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ষষ্ঠ উপাচার্য হিসেবে গত ৩০ নভেম্বর নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে আওয়ামী সমর্থিত নীল দলে শিক্ষকদের মাধ্যমে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের হুমকি প্রদান, ৩ আগস্ট রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের বিশ এর অধিক শিক্ষক নিয়ে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে মিটিং এবং সেখানে আন্দোলন দমনে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষার্থী হত্যার কৌশলকে সমর্থন করে আরও বেশি বল প্রয়োগে আন্দোলন দমনে উৎসাহিত করা এবং সব পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন অধ্যাপক সাদেকা হালিম।
এছাড়া গত ৪ আগস্ট তার উৎসাহে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলে শতাধিক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেন। শিক্ষক নেতারা ঐ দিন স্পষ্টভাবে ছাত্রদের বিরোদ্ধে অবস্থান নেন। এসব অভিযোগের কারনে ৫ আগস্টের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সমাজের আন্দোলনের মুখে ১১ আগস্ট সাদেকা হালিম পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় একমাস জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি শূন্য।
এছাড়াও পুরো প্রক্টরিয়াল বডি ও অন্যান্য পদের পদত্যাগ করায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহ খালি রয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে এখন অস্থিরতা বিরাজ করছে। প্রক্টরিয়াল বডি না থাকায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে শিক্ষার্থীরা।
এমন পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসে চলছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণের মধ্য থেকে ভিসি নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন। এই দাবিতে বিগত প্রায় এক মাস শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভাগ সংযোগ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সমাবেশ এর মাধ্যমে লাগাতার আন্দোলন করে আসছে।
এছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গেইটলক কর্মসূচি করার ঘোষণা দিয়েছে। তারা জানান, যদি বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিসি হিসেবে কেউ নিয়োগ পেতে জগন্নাথে আসে তাহলে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইট দিয়ে ঢুকতে দেওয়া হবেনা।
আরও পড়ুন ইউজিসির চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক আলমগীরের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণ থেকে ভিসি নিয়োগ দেওয়া যায় কিনা সে বিষয়ে খতিয়ে দেখছে তারা। বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নাকি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পাবে এই বেড়াজালে আটকে আছে নতুন উপাচার্য নিয়োগ।
এদিকে জবি শিক্ষকগণের মধ্য থেকে ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে জোর আলোচনায় আছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দিন। তিনি একাডেমিক ও প্রশাসনিক উভয় ক্ষেত্রে একজন দক্ষ ব্যক্তি বলে জানান জবি শিক্ষকরা। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত তার প্রবন্ধের সংখ্যা ২৮ টির অধিক। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, মালয়েশিয়া সৌদি আরব সহ বিভিন্ন দেশে ১৯ টির বেশি সেমিনারে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। ক্যারিয়ারের বিভিন্ন সময় তিনি প্রভোস্ট, প্রক্টর, চেয়ারম্যান, ডিন, সিন্ডিকেট সদস্য সহ অসংখ্য প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ জবির কলা অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দিন বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের সাধারণ সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব) - এর যুগ্ম মহাসচিব।
এছাড়াও আলোচনায় আছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম। তিনি ১৯৮৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগের চেয়ারম্যান ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০০৮ সালে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং সমাজকর্ম বিভাগের চেয়ারম্যান ও সামজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এসময় তিনি বিভিন্ন একাডেমিক রুলস কমিটির সদস্য হিসেবেও কাজ করেছেন।
এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ অভিযোগ করে বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকে ভিসি নিয়োগের দাবিকে দুর্বল করার জন্য একটি মহল পরিকল্পিতভাবে নীল দলের পোস্টধারি কয়েকজন শিক্ষকের নাম ভিসি হিসেবে সামনে এনেছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাদের নাম ও প্রকাশিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড.নাছির আহমাদ বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকে ভিসি দেয়ার দাবিতে আমরা ১ মাস ধরে আন্দোলন করে আসছি। আমি ১৬ বছর ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। এই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি যিনি জবির ভিসি হবেন তাকে ২টি বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। প্রথমত ৫ আগস্ট স্বৈরশাসনের পতনের পর জবির বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ৪১টি বিভাগ থেকে বিভাগ সংস্কারের দাবির পাশাপাশি প্রশাসন সংস্কারের দাবিও উঠেছে। নতুন ভিসি স্যারকে সকল সংস্কারকে এড্রেস করে জবির সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জবির বর্তমান শিক্ষকের সংখ্যা ৬৮১জন। এর মধ্যে আওয়ামী সমর্থিত শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৬০০। তারা নতুন ভিসি স্যারকে নানান ভাবে চ্যালে্ঞ্জ করবেন। তাদের বাধাকে অতিক্রম করে নতুন ভিসি স্যারকে কাজ করতে হবে। এই দুটি বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য নতুন ভিসি স্যারকে একদিকে যেমন একাডেমি হতে হতে হবে অন্যদিকে তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক জ্ঞান সম্পন্ন ও হতে হবে। এই দুই দিক থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার যোগ্য শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য ড. রইছ উদ্দিন স্যার।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জবি শিক্ষকগণের মধ্য থেকে ভিসি নিয়োগ আন্দোলনের অন্যতম আহবায়ক ড. মোহাম্মদ বিলাল হোসাইন বলেন, শিক্ষা, গবেষণা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সমসাময়িক প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক পেছনে রয়েছে। বিগত ঊনিশ বছরে বিভাগ ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধাদি নিশ্চিত করা হয়নি। এক্ষেত্রে আগত উপাচার্যগণের অবহেলা এবং অদক্ষতাই প্রধানত দায়ী। উপাচার্যগণ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের মনে করেননি। যার ফলস্রুতিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার আজ বাহিরের উপাচার্য আগমনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। একটি সত্যিকারার্থে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের মধ্য থেকে যোগ্য, সৎ এবং দক্ষ একজন শিক্ষক উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাবেন, এটি পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণের দাবি। এই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলমান থাকবে।