১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:১৬

৪৮ লাখ টাকার প্রকল্পে ৬০ লাখ লোপাটের চেষ্টা

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) স্পোর্টস গ্যালারি নির্মাণ ও উপাচার্যের বাংলো মেরামতে খরচ হয়েছিল ৪৮ লাখ ২৬ হাজার ৩০১ টাকা। তবে সে বিল সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম. আবদুল মঈনে নির্দেশে প্রকৌশল দপ্তর ঘষামাজা করে ১ কোটি ৭ লাখ টাকা দেখিয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে প্রায় ৬০ লাখ টাকা লোপাট করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে সে বিল পরে আটকে যায় অর্থ দপ্তরে। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত এবং কর্মকর্তারা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব তথ্য আড়াল করতে তড়িঘড়ি পুরোনো তারিখে কয়েকটি গরমিল বিলের তথ্যও উপস্থাপন করে প্রকৌশল দপ্তর। এসব ঘটনায় সাবেক উপাচার্যের সঙ্গে প্রকৌশল দপ্তরের প্রধান শহিদুল হাসানের যোগসাজসের অভিযোগ থাকলেও বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, উপাচার্য যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই তিনি বিল পাস করেছেন।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো টাকার জন্য আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরেজমিন পরিদর্শন শেষে বিল আসে ৩৯ লাখ ৭৮ হাজার ৭২৯ টাকা ও ৮ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭২ টাকা। কিন্তু কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলী সবুজ বড়ুয়া ও মোহাম্মদ মফিজুল ইসলামের সাক্ষরিত একটি বিলের কপিতে দেখা যায়, এ বিল যথাক্রমে ৮৩ লাখ ৬৪ হাজার ৭৭২ টাকা ও ২৩ লাখ ৪ হাজার ১৬০ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলোয়াড়দের জন্য নির্মিত স্পোর্টস গ্যালারি ও বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের কাজ পেয়েছিল ‘ড্রিম ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান, যার টেন্ডার আইডি নম্বর ৯৩৭১৪৯। এ কাজের কার্যাদেশ মূল্য ধরা হয়েছিল ৮৪ লাখ ৯১ হাজর ২৩ টাকা। অন্যদিকে উপাচার্যের বাংলো সংস্কারের কাজ পায় ‘ওরিয়েন্টাল’ নামে আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, যার টেন্ডার আইডি নম্বর ৯৫০৭১৮। এর কার্যাদেশ মূল্য ছিল ২৩ লাখ ৪ হাজার ১৬০ টাকা।

এদিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো টাকার জন্য আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরেজমিন পরিদর্শন শেষে বিল আসে ৩৯ লাখ ৭৮ হাজার ৭২৯ টাকা ও ৮ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭২ টাকা। কিন্তু কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলী সবুজ বড়ুয়া ও মোহাম্মদ মফিজুল ইসলামের সাক্ষরিত একটি বিলের কপিতে দেখা যায়, এ বিল যথাক্রমে ৮৩ লাখ ৬৪ হাজার ৭৭২ টাকা ও ২৩ লাখ ৪ হাজার ১৬০ টাকা।

প্রকৌশল দপ্তরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বিল দপ্তরের কেউ করেনি। প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম নিজে টাইপ করে জোর করে অন্য প্রকৌশলীদের দিয়ে স্বাক্ষর করান। সে সময় তিনি বলেন, ‘উপাচার্য স্যার সবকিছুর জিম্মাদার, আপনাদের এত চিন্তা কীসের? আপনারা স্বাক্ষর করেন, ওনি বিল আটকে রাখবে, কাজ শেষ হলে বিল দিবেন তিনি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রকৌশলী বলেন, ‘কাজ চলাকালীন অনেকবার আমাদেরকে বাংলোতে ডেকে নিয়ে আজেবাজে বকতো উপাচার্য স্যার। এমনকি উপাচার্য স্যার ও শহীদুল স্যার ঢাকায় থাকা অবস্থায় আমাদের অপরিচিত নাম্বার থেকে নানা রকম হুমকি দেওয়া হতো। ওই সময় নিজের চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে কিছু বলার সুযোগ ছিল না। টাকার বিষয়ে শহিদুল হাসান যা বলেন, উপাচার্য স্যারও সেই কথায় বলেন।’ 

অর্থ দপ্তরের সূত্র জানায়, প্রকৌশল দপ্তর বিলের টাকা নিতে দু’বার বিলের কপি জমা দেয়। কিন্তু বিলের মধ্যে গরমিল থাকার কারণে অর্থ দপ্তর কপি গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। অর্থ দপ্তর সরেজমিনের বিল এবং কাজের তদারকি বিষয়ে জানতে প্রকৌশল দপ্তরে চিঠি দিলে তারা এ বিল উপস্থাপন করে। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে তড়িঘড়ি করে করে ৯ ফেব্রুয়ারি সরেজমিন পরিদর্শনের কথা (ব্যাক ডেইট দিয়ে) গত ৭ আগস্ট আরেকটি বিল উত্থাপন করে প্রকৌশলী দপ্তর। 

বিলটি উত্থাপন করার আগেও দু’বার পরিবর্তন হয়। গত ১৪ জুলাই  টাকা চেয়ে চিঠি দেয় প্রকৌশল দপ্তর। ইস্যু করা চিঠিতে বিল উপস্থাপন করে ৫৮ লাখ ৫ হাজার টাকা ও ১৫ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। সে চিঠি নিয়ে টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ৭ আগস্ট পুনরায় বিলের কপি দেয় প্রকৌশল দপ্তর। সেখানে বিলের পরিমাণ উল্লেখ করা হয় ৩৯ লাখ ৭৮ হাজার ৭২৯ ও ৮ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭২ টাকা। তবে সব বিলের কপিতে ৩০ জুনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে ড্রিমের ঠিকাদার মোস্তাক বলেন, ‘আমরা কাজ শেষ করেছি। কিন্তু তারা টাকা দিচ্ছে না। বিলের জন্য চিঠি দিলেও নানান কারণে বিল আটকে দিচ্ছে। প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ ও মুফিজুল ইসলাম আমার ইঞ্জিনিয়ার ফয়সালের কাছে টাকা দাবি করছে।’ যদিও টাকার বিষয়ে ড্রিমের ম্যানেজার ফয়সাল বলেন, ‘আমার কাছে কেউ কোন টাকা চাননি। মোস্তাক ভাইয়ের কাছে চেয়েছে কিনা জানি না। পরে ঠিকাদার মোস্তফার কাছে টাকা চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাকে আমার ইঞ্জিনিয়ার বলেছিল।’

টাকা দাবির বিষয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল লতিফ বলেন, ‘মোস্তাক আমার কাছে এসে বলে ভিসি স্যার, পিডি স্যার (শহীদুল ইসলাম) মেনে নিয়েছে। আপনার বিলে সই করতে সমস্যা কোথায়? কত টাকা লাগবে আপনার? তখন আমি বলি, ৪০ লাখ টাকার কাজে ৮৪ লাখ টাকার বিল করা কাগজে আমি সই করি না। যদি তারা টাকা দিয়ে দেয়, তাহলে আমার কোনো সমস্যা নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি তাদের কাছে কোন ধরনের টাকা চাইনি। বরং আমি সরেজমিনে যত টাকার কাজ হয়েছে, তত টাকার রিপোর্ট করেছি। যারা নিয়মিত ঠিকাদার থেকে টাকা খায়, তারা আমার নামে অপ-প্রচার করছে।’

আরো পড়ুন: ঢাবির এসএম হলে মাইকে আজান দিতে বাধা দেওয়ার দাবিটি ঠিক নয়

এ বিষয়ে প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সব কাজ অন্য প্রকৌশলীদের ভাগ করে দিয়েছি। আমার চেয়ে তারা ভালো বলতে পারবেন। যেখানে বিলের পরিবর্তন দেখছেন, ওটা বিল ছিল না- ড্রাফট ছিল। বিল কেন বারবার পরিবর্তন হয়েছে সেটা আমি জানি না।’ 

বিলে ব্যাক ডেট দিয়ে কেন স্বাক্ষর করলেন, সে বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথমে স্বীকার করে বলেন, ‘জুন ক্লোজিং এর বিষয় ছিল। এছাড়াও এ ধরনের কাজগুলোতে এমন হয়। সেজন্য আমরা হিসাবটা করে ফেলছি।’ পরে অস্বীকার করে বলেন, ‘এটা জুনের কাজ জুনেই শেষ করা হয়েছে। কোন ব্যাক ডেট না। টাকা আত্মসাতের প্রশ্নই আসে না। ভিসি স্যার আমাকে যেমন নির্দেশনা দিয়েছেন, সে রকম করেছি।’

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম. আবদুল মঈনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। ক্ষুদে বার্তা দিলে তারও জবাব দেননি তিনি।