উপাচার্য নিয়োগে কদর পশ্চিমা ডিগ্রি-গবেষণায়, রাজনৈতিক সক্রিয়রা বাদ
ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনের মুখে আওয়ামী সরকারের পতনের পর ভেঙ্গে পড়ে বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো। শীর্ষ বিভিন্ন পদ থেকে দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেন আওয়ামীপন্থি এবং অভিযুক্তরা। বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাদ যায়নি দেশের শিক্ষাঙ্গনও। ফলে শূন্য হয় অসংখ্য প্রশাসনিক পদ। এতে অস্থিরতা দেখা দেয় দেশের শিক্ষাখাতে। তবে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছে সদ্য দায়িত্ব গ্রহণ করা অন্তর্বর্তী সরকার।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর পদত্যাগ করতে হয়েছে— দলীয় নিয়োগে যোগদান করা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের। এছাড়াও দেশের যেসব উচ্চশিক্ষালয়ের উপাচার্যরা এখনও পদত্যাগ করেননি তাদের অনেকের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চলছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। ফলে নাজুক অবস্থানে রয়েছে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক, প্রশাসনিক এবং পাঠদান।
ওয়েস্টার্ন-অস্ট্রেলিয়ায় গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না। রিসার্চে ভালো এমন দক্ষ লোককে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দেওয়া হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আমূল পরিবর্তন সম্ভব—ড. এমরান হুসাইন, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
চলমান এ সংকট কাটানো এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সচল করে দ্রুতই পাঠদান শুরু করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে কাজ শুরুর কথা জানিয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে শূন্য থাকা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ শুরু করেছে সরকার। ইতোমধ্যে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দেশের শীর্ষ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
এছাড়াও নিয়োগ পেয়েছেন দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানও। সরকারের সামগ্রিক এসব নিয়োগে সরকার প্রাধান্য দিচ্ছে হাই-প্রোফাইলদের। সেক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রেড ওয়ানের অধ্যাপকরা। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্য নিয়োগে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর ডিগ্রি। এছাড়াও রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে গিয়ে নিয়োগের প্রভাবও লক্ষণীয় হয়েছে নতুন সরকারের মনোভাবে।
আরও পড়ুন: উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে ডজন খানেক সুপারিশ ইউজিসির
শিক্ষা উপদেষ্টার কার্যালয় সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন—দেশের ভঙ্গুর শিক্ষা কাঠামোর ব্যাপক সংস্কার করা দরকার। সেজন্য দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে যোগ্য ব্যক্তিদের। এর মধ্যে অক্সফোর্ড কিংবা ক্যামব্রিজের মতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি পাওয়া কিংবা ভালো অ্যাকাডেমিক এবং প্রশাসনিক দক্ষতায় এগিয়ে থাকা ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
পশ্চিমা দেশগুলোর প্রথম সারির উচ্চশিক্ষালয়গুলো থেকে উচ্চতর শিক্ষা এবং গবেষণায় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দেশের প্রথম সারির শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার হাল ধরতে দিলে এখাতে পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারাও। আর নতুন সরকারের এ মনোভাবে অনেকটাই ফিকে হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত কিংবা সমমনা দেশগুলো থেকে পিএইচডি অর্জন করা ব্যক্তিরা।
আরও পড়ুন: একক ভর্তি পরীক্ষা: ঢাবি-বুয়েটসহ ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়ে কমিটি, নেতৃত্বে ইউজিসি
অন্তর্ববর্তীকালীন সরকারের সাম্প্রতিক নিয়োগে প্রাধান্য পেয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেন, নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলোর প্রথমসারির উচ্চশিক্ষালয়গুলো। এর মধ্যে রয়েছে—অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রয়েছে।
সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মাননাসহ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা সম্পাদন করেন। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগে পাওয়া অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন অস্ট্রেলিয়া থেকে।
আরও পড়ুন: একক ভর্তি পরীক্ষা বিষয়ে অধ্যাদেশ জারির সুপারিশ ইউজিসির
এর বাইরে—ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ-পদে নিয়োগ পান। এছাড়াও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নিয়ে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইসমাইল। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়া অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন কারডিফ ইউনিভার্সিটি।
সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি জানান, উচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে, প্রশাসনিক দক্ষতা আছে, বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে যোগ্য—এমন মানুষ খুঁজে আমরা তাদের দায়িত্ব দেওয়ার চেষ্টা করছি। উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে যোগ্যদের খুঁজে দায়িত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান আছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী না ভাবার জন্য অন্য শিক্ষকদের প্রতি অনুরোধ থাকবে।
আরও পড়ুন: ছাত্রদল নেতাদের নেতৃত্বে ইউজিসিতে 'ক্যু', সচিবকে অপসারণ
অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আমার কাছে শত শত সুপারিশ আসছে নানা দিক থেকে। আমি আমার মতো যোগ্য, যাদের পদায়ন করা যায়, বিভিন্নভাবে খোঁজার চেষ্টা করছি। আশা করি যে অচিরেই আমরা অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিতে পারব। আমি আশা করি, সবকিছু মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আবার শান্তিপূর্ণভাবে চালু হবে, শিক্ষাক্রম চালু হবে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাময়িকভাবে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, যেসব উপাচার্যকে এসব পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে—সেখানে কিন্তু প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়, স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজেদের একটা নিয়ম আছে—সিনেটের মাধ্যমে এবং নানা প্রক্রিয়ায় উপাচার্য নিয়োগ হন। এই পদ্ধতি তো চালু থাকবেই। প্রশ্ন উঠতে পারে—এখন আমরা নিয়োগ দিচ্ছি কীভাবে? আসলে পুরো পদ্ধতি গ্রহণেরও তো সময় নেই। আমাদের তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চালু করতে হবে। কাজেই এটা সাময়িকভাবে নিয়োগগুলো দিতে হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে নিশ্চয়ই নিয়মানুগভাবে সব কিছু হবে। এখন তো পুরো প্রক্রিয়ায় যাওয়ার সুযোগ নেই বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুন: বুয়েটে গবেষণাগার উন্নয়নে আড়াই হাজার কোটি টাকা টাকার প্রকল্প
যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. এমরান হুসাইন বলেন, দেশের উচ্চশিক্ষার মান ধরে রাখতে গবেষণামুখী প্রশাসন নিয়োগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি। বর্তমানে দেশে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা শোনা যাচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে ওয়েস্টার্ন ও অস্ট্রেলিয়ান দেশ থেকে যারা পিএইচডি ডিগ্রি ও পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রি করছেন তাদের প্রাধান্য দিয়ে দেশের উচ্চশিক্ষার আমূল পরিবর্তন আনা যেতে পারে। কেননা এসব দেশে গবেষণা খুবই উৎকৃষ্ট হয়ে থাকে।
দেশীয় কিংবা ভারতীয় এবং ওয়েস্টার্ন-অস্ট্রেলিয়ান পিএইচডির পার্থক্য কেমন—জানতে চাইলে ড. এমরান হুসাইন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এর মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। ওয়েস্টার্ন-অস্ট্রেলিয়ায় গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না। কিন্তু দেশীয় পিএইচডিতে গিভ এন্ড টেক অর্থাৎ সমঝোতার ভিত্তিতেও অনেক সময় হয়ে থাকে। সেজন্য রিসার্চে ভালো এমন দক্ষ লোককে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দেওয়া হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আমূল পরিবর্তন সম্ভব।